4:00 AM, September 30, 2024
A THOUSAND SPLENDID SUNS
(প্রথম পর্ব)
KHALED HOSSEINI
প্রথম খন্ড:-
গল্পটি শুরু হয় মারিয়মকে নিয়ে। মারিয়ামের জন্ম হয় ১৯৫৯ সালের বসন্তের একটি দিনে। তার যখন ৫ বছর বয়স তখন সে সর্বপ্রথম "হারামি" শব্দটির সাথে পরিচিত হয়। এটি নিশ্চিত বৃহস্পতিবারই ছিল কারণ সেইদিনই জলিল তাকে দেখতে কোলবাতে এসেছিলেন। সে চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে জলিলকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখবার চেষ্টা করছিল, হাতে ছিল মায়ের প্রিয় চাইনিজ টি-সেট। এটাই ছিল মারিয়মের নানীর কাছ থেকে পাওয়া তার মায়ের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন। মরিয়মের মা "নানা"-র যখন দুই বছর বয়স তখন তিনি এটা উপহার পেয়েছিলেন। খুব যত্নের সাথে তিনি এগুলো রেখেছিলেন। কিন্তু চাইনিজ চায়ের সেটের সর্বশেষ পেয়ালাটি মারিয়ামের হাত থেকে কোলবার কাঠের মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। নানা যখন তা দেখতে পান তখন তিনি ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং মারিয়মকে কাছে টেনে এনে বলেন,"তুই একটা বজ্জাত অকর্ম হারামি"। মারিয়ম অবশ্য সেই সময় কথাটার কোনো মানে বুঝতে পারেনি। সে জানতো না এই হারামি বা বেজন্মা শব্দটার অর্থ কী। তবে সে এইটুকু বুঝতে পেরেছিল যে এটা একটা খারাপ শব্দ বা বাজে কিছু। জলিল অবশ্য কখনো মারিয়মকে এই নামে ডাকেনি। জলিল তাকে সব সময় বলতো যে সে হল জলিলের ছোট্ট ফুল। তিনি মরিয়ামকে তার কোলে বসিয়ে চমৎকার গল্প শোনাতেন এবং মারিয়ম তা মুগ্ধ হয়ে শুনত। অবশ্য জলিল চলে যাওয়ার পর মারিয়মের মা তাকে বলতেন এই সমস্ত কিছু মিথ্যে কথা। তার বাবা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি তার চমৎকার বাড়ি থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। জলিল ছিলেন হিরাতের সবচেয়ে ধনবানদের মধ্যে একজন। তার একটি সিনেমা হল ছিল, যা মারিয়াম কখনো চোখে দেখেনি। সিনেমা হলের পাশাপাশি তার অনেক জমিও ছিল, কাপড়ের দোকান ছিল। মারিয়ামের মা জলিলের একজন গৃহকর্মী ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি গর্ভবতী হন। জলিলের পরিবারের অন্যরা চাইলো জলিল যেন তাকে ছুঁড়ে ফেলে আসে। নানার বাবা ছিলেন খুব ক্ষুদ্র একজন পাথর ভাঙ্গার শ্রমিক এবং তিনি গুলডামান গ্রামের পাশেই বসবাস করতেন। তিনি এই খবর শুনে নানাকে পরিত্যাগ করে চিরদিনের জন্য ওই গ্রাম ছেড়ে ইরানে চলে যান। সম্মানজনক কিছু করার মতো বড় অন্তর জলিলের ছিল না, যেমন সে যা করেছে তার দায়িত্ব নেওয়া। তার পরিবর্তে তিনি নানাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং তিনি তাঁর অন্য স্ত্রীদের বলেছিলেন যে নানাই এই কুকাজের জন্য তাকে বাধ্য করেছে। নানা মারিয়ামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে,"কম্পাসের কাঁটা যেমন সব সময় উত্তর দিকে ফিরে থাকে ঠিক সেভাবে পুরুষের আঙ্গুল মেয়ে মানুষকে দোষারোপ করার জন্য সব সময় সেদিকে ফিরে থাকে।"
মারিয়মের মা জলিলের শহর হেরাতে থাকতে অস্বীকার জানায়, তিনি গুলডামান গ্রামেও থাকতে চাননি। তিনি এমন একটা জায়গায় তার মেয়েকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। জলিলের প্রথম স্ত্রী, খাদিজার বড় ছেলে মুহসিন তাদের দুজনকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
তিনি মারিয়মকে আরও বলেন তার যখন পনেরো বছর বয়স তখন তার একবার বিয়ে হয়েছিল। তিনি ছিলেন সিনদান এলাকার এক তরুণ টিয়া পাখি ব্যবসায়ী। গল্পটি বলার সময় নানার চোখের উজ্জ্বল আলো দেখে মারিয়ম বুঝেছিল যে সেই কয়েকটা বছর নানা সত্যিকার অর্থেই সুখী ছিলেন। কিন্তু সেই সময় নানার মাকে জিনে ধরে। এই খবর সিনদান এলাকার টিয়া পাখি ব্যবসায়ীর কানে পৌঁছালে তিনি সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
জলিলের ঘর থেকে যখন নানাকে বের করে দেওয়া হয় তখন জলিলের দুই ছেলে ফারহাদ এবং মুহসিন মিলে মারিয়ম এবং তার মায়ের জন্য ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে দেয়, যেখানে মারিয়ম তার জীবনের প্রথম ১৫ টা বছর কাটিয়েছে।
মারিয়মের মায়ের মতে যেদিন মারিয়ামের জন্ম হয় সেদিন তার পাশে একটা মানুষও ছিল না তাকে সহায়তা করার জন্য। তার মতে সেই সময় জলিল তার জন্য একজন ডাক্তার তো দূরে থাক একজন দাই মহিলার ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন মনে করেননি। নানা সারাদিন ওই কুঁড়ে ঘরের মেঝেতে শুয়ে কাতরেছে। আর জলিল সেই সময় সাফারে তার বন্ধুদের সাথে ঘোড়ায় চড়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু জলিল মারিয়মের কাছে এই সমস্ত কিছুই অস্বীকার করেন।
মারিয়মের দুই সৎ ভাই মুহসিন ও রামিন আবার কখনো কখনো রামিম ও ফারহাদ মাসে একবার ঠেলা গাড়িতে করে তাদের চাল,ময়দা,তেল, সাবান, টুথপেস্ট ইত্যাদি দিয়ে যেত।
নানার সাথে যারা দেখা করতে আসতেন নানা তাদের সবার সাথেই খারাপ ব্যবহার করতেন, তবে দুজন ব্যক্তি ছাড়া। একজন ছিলেন গুলডামান শহরের নেতা গ্রাম্য মাতব্বর হাবিব খান, তিনি মাসে এক আধবার তাদের সাথে দেখা করতে আসতেন। আর একজন ছিলেন দেখতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বুড়ো মহিলা, নানা যাকে বিবি জো বলে ডাকতেন।
মারিয়মের কাছে জলিলের পর আরেকজন মানুষ খুব পছন্দের ছিলেন, তিনি ছিলেন মোল্লা ফয়জুল্লাহ। তিনি গ্রামের মানুষদের কোরআন পড়া শেখাতেন। তিনি মারিয়মদের বাড়িতে গুলডামান থেকে সপ্তাহে একবার কি দুইবার আসতেন তাকে কোরআন শেখানোর জন্য। তিনি কোলবাতে সাধারণত একাই আসতেন, তবে মাঝে মাঝে তার সাথে থাকতো তার ছেলে ফ্যাকাশে চুলের হামজা। মোল্লা ফয়জুল্লাহ মারিয়মের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি কোরআনের অর্থ বুঝতে পারেন না কিন্তু কোরআনের আরবি শব্দগুলো তার হৃদয়কে আরাম দেয়।
মারিয়ম তাদের বাড়িতে লোকজনের যাওয়া আসাটা খুব পছন্দ করত, বিশেষ করে বিবি জো আর মোল্লা ফয়জুল্লাহ আসলে। বাড়িতে এনাদের উপস্থিতি মারিয়মকে খুব আনন্দিত করত। কিন্তু তার বাবা জলিল ছাড়া এমন কেউ ছিলনা যার জন্য মারিয়ম দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে থাকত। একমাত্র জলিলের উপস্থিতি তাকে সব থেকে বেশি আনন্দিত করত। মঙ্গলবার রাত থেকেই তার উদ্বেগ শুরু হয়ে যেত। বুধবার ঘুম থেকে উঠে সে এদিক ওদিক হাটাহাটি করত, মুরগিগুলোকে খাবার দিত, ঘুরে বেড়াত। অবশেষে,বৃহস্পতিবার সকালে তার বাবার আসার দিন সে একটা দেওয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে সকাল থেকে বসে থাকত আর অপেক্ষা করতে থাকত। জলিলের যদি আসতে দেরি হত তখন মারিয়মের বুকের কম্পন বেড়ে যেত। যখন তার মা তাকে বলতেন যে তার বাবা আসছে, তখন মারিয়মের মনে হত রাস্তার পাথরগুলো যেন হাসছে। জলিল যখন উঠোনে এসে দাঁড়াতেন তখন তার শরীরের কোটটা ছুড়ে ফেলে হাত দুটো মেলে ধরতেন। মারিয়ম প্রথম একটু হেঁটে তারপর ছুটে তার বাবার কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জলিল মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেন। মারিয়ম তখন আহ্লাদে শব্দ করতে থাকত। জলিলের অনুপস্থিতিতে নানা যদিও তাকে অনেক গালিগালাজ করতেন কিন্তু জলিল যখন বাড়িতে এসে উপস্থিত হতেন তখন তিনি জলিলের সাথে অনেক ভদ্র আচরণ করতেন। জলিল আসার সময় হেরাত থেকে পত্রিকা নিয়ে আসতেন। জলিল ছিলেন মারিয়মের একটি সংযোগ মাধ্যম বাইরের পৃথিবীর সাথে। তার মাধ্যমেই মারিয়ম জানতে পারত এই কোলবার বাইরে এমনকি গুলডামান এবং হেরাত শহরের বাইরেও একটি পৃথিবী রয়েছে। জলিল যখনই মারিয়ামকে দেখতে আসতেন তখনই তিনি কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। জলিল চলে যাওয়ার সময় মারিয়ম সবসময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। সে শ্বাস বন্ধ করে দরজায় দাঁড়িয়ে তার বাবার চলে যাওয়া দেখত। সে মনে করত যে যখন সে শ্বাস বন্ধ করে রাখে তখন খোদা তার জন্য কবুল করতে থাকে যে তার বাবা খুব শিগগির আবার তাকে দেখতে আসবে। মারিয়ম ভাবে খুব শিগগির সে জলিলকে বলবে যে সে যখন চলে যায় তখন মারিয়ম তাকে খুব অনুভব করে। তখন জলিল নিশ্চয়ই তাকে তার সাথে হেরাতে নিয়ে যাবে এবং মারিয়ম জলিলের অন্য সন্তানদের মতো তার সাথে থাকতে পারবে।
একবার জলিল মারিয়ামকে বলেছিলেন যে তার সিনেমা হলে কার্টুন সিনেমা চলছে। তার কিছুদিন পর মারিয়ম তার বাবাকে বলে সে যেন তাকে তার সিনেমা হলে নিয়ে যায়। মারিয়ামের এই ধারণা সম্পর্কে নানা বলেন এটি খুব বাজে একটি প্রস্তাব। তার কিছুদিন পর জলিলের সাথে একা থাকাকালীন সময়ে মারিয়ম আবার তাকে বলে যে সে সিনেমায় যেতে চায় এবং সে তার ভাইবোনদের সাথেও দেখা করতে চায়। জলিল তাকে সিনেমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কাউকে পাঠানোর প্রস্তাব দেয় কিন্তু মরিয়ম জলিলকেই তাকে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানায় এবং অবশেষে জলিল রাজি হয়। নানা তার প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার লক্ষণ হিসেবে মারিয়মের সিনেমায় যাওয়ার অভিপ্রায় খুঁজে পান এবং তিনি মারিয়মকে বলেন তাকে অবশ্যই বাড়িতে থাকতে হবে। নানা জানান যে তিনিই একমাত্র তাকে ভালোবাসেন, তিনি যদি মারা যান তাহলে মারিয়ামের আর কিছুই থাকবে না, তার নিজের কোনো পরিচয়ও থাকবেনা। তিনি আরও বলেন যে মারিয়াম চলে গেলে তিনি মারা যাবেন। মারিয়ম নানার কথা শোনে না এবং তার প্রতি বিরক্ত বোধ করে।
সিনেমায় যাওয়ার দিন অনেক অপেক্ষার পরও জলিল মারিয়মকে নিতে আসে না, তাই মারিয়ম নিজেই হেরাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে পৌঁছে শহরটি দেখে মারিয়ম অবাক হয়ে যায় এবং একজন ঘোড়ার গাড়ি চালকের সাহায্যে জলিলের বাড়িতে পৌঁছায়। তাদের বাড়ির দারোয়ান মারিয়মকে বলে যে জলিল ব্যবসার জন্য অনির্দিষ্টকাল বাড়ি থেকে দূরে আছেন এবং তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে। মারিয়াম যেতে অস্বীকার করে এবং জলিলদের বাড়ির বাইরে সারারাত কাটায়। সকালে মারিয়ম কৌশলে জলিলের বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ে। সে অবাক বিস্ময়ে বাগানের ভেতরটা দেখতে থাকে। খুব বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ না দিয়ে দুটো শক্ত হাত তাকে চেপে ধরে এবং কোলে করে নিয়ে তাকে গাড়ির পেছনে সিটে রাখে। গাড়ির পেছনের সিটে বসে মরিয়ম লজ্জায় এবং বিশ্বাসঘাতকতায় পুরো রাস্তা কাঁদতে থাকে। মারিয়ম মনে করে জলিলের সম্পর্কে বলা তার মায়ের কথাই ঠিক ছিল। কোলবাতে পৌঁছানোর পর মারিয়ম দেখে গাছের উঁচু ডাল থেকে তার মা নানা একটি দড়ির সাহায্যে ঝুলে আছে।
গুলডামানের কবরস্থানের একপাশে নানাকে কবর দেওয়া হয়। জলিল বাড়ি ফেরার পথে মারিয়মকে নিজের সাথে হেরাতে নিয়ে যান এবং মারিয়মকে বলেন যে সে তার সাথে তাদের বাড়িতে থাকতে পারে।
মারিয়ম অনুভব করে জলিলের বাড়িতে সবার ঠান্ডা চোখ তার দিকে, সবাই তাকে নিয়ে ফিসফিস করছে। বাথরুম ব্যবহার করা ছাড়া, মারিয়ম তার শোবার ঘর থেকে বের হত না। তার জন্য খাবার দিয়ে যাওয়া হত। জলিল তাকে দেখতে আসতেন এবং মারিয়মকে তাদের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অযৌক্তিক চেষ্টা করতেন। মারিয়ম বুঝতে পারে যে জলিলের বাড়িতে তার কোনো অধিকার নেই, সে অনুভব করে যে তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
জলিলের এক মেয়ে নিলুফার গ্রামোফোন নিয়ে মারিয়মের ঘরে খেলতে আসে। সে মরিয়মকে বলে যে তার মা তাকে বলেছে মারিয়ম আসলে তার বোন নয়, সে এটাও বলে যে মারিয়ম যদি তার সত্যিকারের বোন হয় তবে তার কোনো আপত্তি নেই। সে বলে যে একটি জিন নানাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে, এখানে মারিয়মের নিজেকে দায়ী করা উচিত নয়।
বিবি জো এবং মোল্লা ফয়জুল্লাহ মারিয়মের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তারা মারিয়মকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে নানার মৃত্যুতে তার কোনো দোষ ছিল না। মোল্লা ফয়জুল্লাহ ইঙ্গিত করেন যে নানার একটি অস্থির যৌবন ছিল, কিন্তু মারিয়ম এখনো নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে।
শীঘ্রই জলিল এবং তার স্ত্রীরা, মারিয়মকে জানায় যে রাশেদ নামে জলিলের এক ব্যবসায়িক বন্ধু যিনি কাবুলে থাকেন তিনি মারিয়মকে বিয়ের জন্য পছন্দ করেছেন। রাশেদের একটি জুতোর দোকান রয়েছে। মারিয়ম তাদেরকে বলে যে সে বিয়ে করতে চায় না এবং এটাও বুঝতে পারে যে বিয়েটা তাকে পরিত্রাণের চেষ্টা মাত্র। মারিয়ম তাদের জিজ্ঞেস করে যে সে মোল্লা ফয়জুল্লাহর সাথে থাকতে পারবে কিনা কিন্তু জলিলের স্ত্রীরা তা অস্বীকার করে। মারিয়ম তার বিবাহিত পরবর্তি জীবন চিন্তা করে বিরক্ত বোধ করে। সে জানতে পারে আগামীকাল তার বিয়ে হবে এবং জলিল অনেক আগেই রাজি হয়ে গেছেন। মারিয়ম প্রতিবাদ করলেও জলিল আয়োজন বন্ধ করতে কিছুই করেন না এবং তারা মারিয়মকে রাতের জন্য ঘরের মধ্যে আটকে রাখে।
বিয়ের দিন রাশেদকে প্রথম দেখে মারিয়ম। সে একজন আড়ম্বরপূর্ণ মানুষ। বিয়ের সময় মোল্লা কোনো আপত্তি আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে জলিল জানায় তার কোনো আপত্তি নেই। রাশেদকে বিয়ে করতে মারিয়ম রাজি কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে মারিয়ম ততক্ষণ চুপ থাকে যতক্ষণ না জলিল তাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্ররোচিত করে। অবশেষে বিবাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
জলিল মারিয়মকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে থাকে যে কাবুল সুন্দর, মারিয়ম জলিলের মুখোমুখি হয় এবং তাকে জানায় যে তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। মারিয়ম এবং রাশেদ বাসে উঠে এবং কাবুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। জলিল বাসের বাইরে থেকে মারিয়মের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন কিন্তু মারিয়ম তার দিকে কোনো মনোযোগ দেয় না।
রাশেদ এবং মারিয়াম কাবুলে রাশেদের বাড়িতে আসে। অগোছালো রাস্তার ওপর শালীন একটি বাড়ি, কিন্তু কোলবার তুলনায় বাড়িটা অনেক বড়ো। মারিয়ম তার পুরনো জীবনের কথা মনে করতে থাকে। রাশেদ মারিয়ামকে জানায় যে সে একা ঘুমাতে পছন্দ করে এবং মারিয়মকে তার নিজের ঘর দেখিয়ে দেয়। মারিয়ম এতে স্বস্তি পায়।
মারিয়ম বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই কাটায়। সে খুব বিষন্ন এবং অসুখী বোধ করতে থাকে, মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে থালা বাটি ঘষামাজা করে, নাড়াচড়া করে। তার মনে হতে থাকে এই নতুন জীবন যেন তার জীবন নয়,অন্য কারো জীবন। এই ঘরে একা একা মারিয়ম বিরামহীন ভাবে শুধু নিচে রান্নাঘর আর উপরের শোয়ার ঘরে পায়চারি করতে থাকে। জানালার পাশে বসে শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, মা-র কথা ভাবে আর হেরাতে তাদের ছোট্ট বাড়িটার কথা চিন্তা করে কষ্ট পায়।
সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে মারিয়ম রাশেদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপতে থাকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মারিয়ম অস্থির হয় আর রাশেদ নিচে বসে রাতের খাবার খেতেন। কাজ থেকে ফেরার পর রাশেদ মারিয়মকে তার সারাদিনের কথা জানাতেন। এক সপ্তাহ পর রাশেদ মারিয়মকে বলেন যে তাকে এবার একজন স্ত্রীর মতো কাজ করা শুরু করতে হবে এবং সব সময় কান্না করা বন্ধ করতে হবে। পরদিন সকালে রাশেদ কাজে যাওয়ার পর মারিয়ম সুটকেস থেকে কাপড় গুলো বের করে আলনার মধ্যে রাখে, ঘর পরিষ্কার করে, রান্না করে এবং খাবার কেনাকাটা শুরু করে। ময়দার একটি মন্দ তৈরি করে সেগুলোকে একটি ভেজা কাপড়ে জড়িয়ে নিচে নেমে আসে যেখানে তন্দুর তৈরি করা হয় সেখানে। রাশেদ তাকে বলেছিলেন কোথায় তন্দুর তৈরি করা হয়। তন্দুরি লাইনে দাঁড়িয়ে মারিয়ম চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ্য করছিল যে কেউ কেউ তাকে লক্ষ্য করে ফিসফিস করে কিছু বলছে। মারিয়মের ভয় হতে থাকে, তার মনে হতে থাকে যে এখানকার মহিলারা হয়তো সবাই জেনে গেছে যে সে একজন বেজন্মা এবং সে তার বাবার ভুল এবং লজ্জার ফসল। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আছে এবং মারিয়ামের কল্পনা মিথ্যে হয়। মারিয়মের কাঁধে কেউ একজন হাতে রাখে এবং পিছন ফিরে তাকালে সে দেখতে পায় তার মতোই হিজাব পরা একজন মহিলা তার কাঁধে হাত রেখেছে। মহিলাটি মারিয়ামের সাথে পরিচিত হন। তার নাম ফারিবা, রাশেদের বাড়ির পাশেই তার বাড়ি। সে তার ছেলের সাথেই মারিয়মের পরিচয় করিয়ে দেন। মারিয়ম এবং ফারিবার কথার মাঝে বাজারের অন্য মহিলারাও এসে মারিয়মকে ঘিরে ধরে এবং নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকে। এতে মারিয়াম ভয় পায় এবং ছুটে ওখান থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর সে বুঝতে পারে যে সে ভুল রাস্তায় চলে এসেছে এবং উল্টো দিকে ঘুরে আবার দৌড়াতে শুরু করে।দৌড়াতে দৌড়াতে খুব খারাপ ভাবে পরে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেলে। হঠাৎ করেই সে বুঝতে পারেনা কোনটা রাশেদের বাড়ি। সে পাগলের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে, বিভিন্ন বাড়ির দরজায় করাঘাত করতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে অবশেষে সে তার বাড়ি খুঁজে পায়। জীবনে সে কখনোই নিজেকে এত বিপন্ন আর একা অনুভব করেনি।
বাড়ি ফিরে এসে রাশেদের জন্য রান্না করে, ডাল ভাত। রাশেদ বাড়ি ফিরলে সে তার সামনে খাবার রাখে। রাশেদ তার খাবারের প্রশংসা করলে মারিয়ম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। রাশেদ থলে থেকে একটি বোরখা বের করে মারিয়মকে দেয় এবং পরের ছুটির দিনে তারা ঘুরতে যাবে বলে জানায়।
মারিয়ম ইতিপূর্বে কখনো বোরখা পড়েনি,রাশেদ তাকে সাহায্য করে। তারা শহরের একটি পার্কে এসে পৌঁছায়, বাচ্চাদের খেলা দেখে, দুজনে একসাথে হাঁটে। এরপর তারা একটি রেস্টুরেন্টে ঢোকে খাবার খাওয়ার জন্য। মারিয়ম এর আগে কখনো রেস্টুরেন্টে খায়নি তাই সে খুব অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সমস্ত অস্বস্তি ভাব কেটে যায়, আশেপাশের সব কিছুই তার ভালো লাগতে শুরু করে এবং সে অবাক হয়ে দেখতে থাকে যে বোরখা পরা অবস্থাতেও তার কোনো অস্বস্তি হচ্ছে না। মারিয়ম কাবুলের এই অঞ্চলের মহিলাদের দেখে মুগ্ধ হয়। রাশেদ যে অঞ্চলে থাকে সেখানকার মহিলারা প্রায় সবাই নিজেদেরকে পরিপূর্ণ ঢেকে রাখে। কিন্তু এখানকার মহিলারা মর্ডান, একা একা রাস্তাঘাটে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই মহিলারা হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কার্ট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। মারিয়ম লক্ষ্য করে এদের হাতের নখ অনেক বড় এবং সেগুলি নানা রঙ দিয়ে পালিশ করা, লিপস্টিক দিয়ে তাদের ঠোঁট রাঙানো। তারা উঁচু হিলের জুতো পড়ে খুব দ্রুত হেঁটে বেড়াচ্ছিল এবং মারিয়ম তাদের শরীর থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ পাচ্ছিল। মারিয়ম ধারণা করে এনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রী রয়েছে। এই রমণীরা মারিয়মের কাছে খুব রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পর রাশেদ তার কাঁধে হাত রাখলে সে তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। রাশেদ তাকে সুন্দর সোনালী রঙের সুতো দিয়ে নকশী করা চাদর উপহার দেয়। মারিয়ম মনে করে জলিলের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের পরিবর্তে এটা সত্যিকারের ভালোবাসার উপহার। সেই রাতে রাশেদ মারিয়মের ঘরে আসে এবং তাকে স্পর্শ করে। মারিয়মের প্রতিবাদ সত্ত্বেও রাশেদ জোর করে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। রাশেদ মারিয়মকে বলে যে যৌনতার কোনো লজ্জা নেই এবং লোকেরা এই জন্যই বিয়ে করে।
১৯৭৪ সাল, রমজান মাস শুরু হয়।
কাবুলে মারিয়ম প্রথম ঈদ উদযাপন করে। মারিয়ম এই প্রথম তার জীবনে লক্ষ্য করল কীভাবে একটি নতুন চাঁদ সারা শহরের চেহারাটা পরিবর্তন করে দিতে পারে। তার ১৫ বছরের জীবনে সর্বপ্রথম সে সমাজবদ্ধভাবে একটি রীতির মধ্য দিয়ে রোজা রাখে আর ইফতার করে। খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন ছাড়া অধিকাংশ সময় রাশেদ রোজা রাখত না। প্রায় সময়ই যখন সে বাসায় ফিরত তার মেজাজ থাকতো তিক্ত। সে থাকত ক্ষুধার্ত, বিরক্ত আর অসহিষ্ণু। মারিয়মদের সেই পুরাতন ঝুপড়িতে থাকার সময় রোজার পরবর্তী ঈদের তিন দিন মারিয়ম আর তার মার সাথে জলিল দেখা করতে আসতেন। মারিয়মের জন্য উপহার নিয়ে আসতেন,তারা তিনজনে বাইরে বসে চা খেত। জলিল দেরিতে আসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। জলিল চলে যাওয়ার পর মারিয়মের মা তাকে বলতেন নিজের আসল পরিবারের সাথে ঈদ কাটিয়েছে তাই তার দেরি হয়েছে। মোল্লা ফয়জুল্লাহ ও তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনি মারিয়মের জন্য চকলেট আর সেদ্ধ ডিম নিয়ে আসতেন। এই বছরই প্রথমবারের মতো মারিয়ম তার নিজের কল্পনার চোখ দিয়ে ফেলে আসা শিশুকালের ঈদ উৎসবের স্মৃতিগুলো দেখতে লাগলো।
রাশেদ এবং মারিয়ম রাস্তায় বের হয়। সবাই ঈদ উপলক্ষে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া আসা করছে। রাস্তায় মারিয়ামের সঙ্গে ফারিবার দেখা হয়। ফারিবা মারিয়ামকে লক্ষ্য করে অভিবাদন জানালেও মারিয়াম খুব স্বল্পভাবে মাথা নেড়ে তার উত্তর দেয়। রাশেদ মারিয়মকে বলে ফারিবার থেকে দূরে থাকতে কারণ রাশেদের চোখে ফারিবা একজন পাজি মহিলা। ওই রাতে তারা চামানে যায়। রাশেদের পাশে মারিয়ম দাঁড়িয়ে আকাশে নানা রকমের বাজি ফাটানো দেখে। মারিয়ম মনে করতে থাকে হেরাতে তার শিক্ষক মোল্লা ফয়জুল্লাহর পাশে বসে সে এরকম বাজি ফাটানো দেখতো এবং মারিয়ম তার মাকেও অনেক বেশি মনে করতে থাকে।
মারিয়মদের বাড়িতে অনেক লোক আসে ঈদ উপলক্ষে। তারা সকলেই রাশেদের বন্ধু। যখনই ঘরের দরজায় কোনো শব্দ হত তখনই মারিয়ম নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। কারণ রাশেদ তাকে বলেছে তার বন্ধুরা বাড়িতে আসলে সে যেন ঘরের ভেতর বসে থাকে। ঈদের তৃতীয় দিনে রাশেদ তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে বাইরে যাওয়ার পর মারিয়ম ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করে। ঘর আর সিঁড়ি পরিষ্কার করার উসিলায় মারিয়ম প্রথম রাশেদের ঘরে ঢোকে। দরজার পাশে রাখা একজোড়া পলিশ জুতো সে হাতে নেয়। সে দেখে রাশেদের বিছানার পাশেই এক প্যাকেট সিগারেট রাখা আছে। মারিয়ম সিগারেট প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে নিজের ঠোঁটে রাখে তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাকে টানার ভান করে বাতাসে ধোঁয়া ছাড়ে। সে ভাবলো কখনোই সে কাবুলের মহিলাদের মত সিগারেট টানতে পারবে না। তারপর সে রাশেদের কাপড় রাখার আলমারির উপরের তাকটা খোলে এবং দেখে সেখানে একটি বন্দুক রাখা। মারিয়ম ভেবে নেয় নিশ্চয়ই এটা সে রেখেছে তাদের নিরাপত্তার জন্য। এরপর সে কিছু অশ্লীল ম্যাগাজিন পায়। আলমারির নীচের তাক থেকে মারিয়ম একটি ছোটো বাচ্চার ছবি এবং একটি মহিলার ছবিও পায় যারা ছিলেন রাশিদের প্রথম স্ত্রী ও সন্তান। রাশেদের দুঃখের কথা ভেবে মারিয়মের মন খারাপ হতে থাকে এবং সে অনুভব করতে শুরু করে যে সে এবং রাশেদ একটি ভালো জুটি তৈরি করতে পারে।
মারিয়াম গর্ভবতী হয় এবং রাশেদ একটি ছেলের প্রতি তার পছন্দ সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ছিল। রাশেদ গর্ভাবস্থার বিষয়ে সত্যিকারের খুব খুশি হয় এবং ইতিমধ্যেই অনাগত শিশুকে তীব্রভাবে ভালবাসতে শুরু করে। মারিয়ম মনে করে যে আল্লাহ অবশ্যই তার সাথে এটি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং প্রার্থনা করে তার সুখ এবং শিশুর জীবন যেন বজায় থাকে।
রাশেদ মারিয়মকে হামাম খানায় নিয়ে যায় গোসল করানোর জন্য। মারিয়ম কখনো সেখানে যায়নি, তার যাবার ইচ্ছেও ছিল না। রাশেদ জানায় এটা খুব ভালো একটা অভিজ্ঞতা হবে। ওইখানে মারিয়ম একটি দুর্ঘটনার শিকার হয় যাতে তার রক্তপাত হয় এবং মারিয়ম অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনার কারণে মারিয়ম তার সন্তান হারায়। মারিয়ম তার সন্তান হারানোর শোকে কাবু হয়ে যায় এবং সে অন্য মায়েদের দেখে ঈর্ষান্বিত বোধ করে। মরিয়ম মনে করে যে সে শিশুর যোগ্য নয় কারণ সে তার মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে স্বপ্নে দেখে যে একটি জিন তার বাচ্চা চুরি করছে। সে নিজের উপর, রাশেদের ওপর এবং আল্লাহর উপর রাগ করে।
রাশেদ অনেক বেশি চুপচাপ নিঃস্ব হয়ে যায়। সে আর হাসেনা, মারিয়ামকে উপহার কিনে দেয় না। মারিয়ম রাশেদকে জিজ্ঞেস করে যে সে তার উপর রাগান্বিত কিনা, কিন্তু রাশেদ জোর দিয়ে বলে যে সে তা নয়। মারিয়ম শিশুটির জন্য একটি সংক্ষিপ্ত দাফন সেবার পরামর্শ দেয়, কিন্তু রাশেদ এতে অংশ নিতে অস্বীকার করে। মারিয়ম নিজেই একটি ছোটো অনুষ্ঠান করে।
১৯৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল মারিয়ম উনিশ বছরে পা রাখে। সে বছরই মীর আকবর খাইবার নামে এক লোকের খুন হয়। কাবুলে সেই জন্য বিশাল এক মিছিল বের হয়। রাস্তায় প্রতিবেশীরা বিষয়টা নিয়ে খুব উত্তপ্ত আলোচনায় মেতে ওঠে। মারিয়ম আর রাশেদ প্রতিবেশীদের কোনো আড্ডায় যোগ দেয় না। তারা একসাথে বসে রেডিওতে খবর শোনে। তারা শুনছিল ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের একটি মিছিল কাবুলের রাস্তায় নেমেছে। রাশেদ বলে মীর আকবর খান একজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন এবং তার সামর্থকরা আকবরের হত্যার জন্য প্রেসিডেন্ট দাউদ খানকে দায়ী করছে। মারিয়ম রাশেদকে জিজ্ঞেস করে কমিউনিস্ট কী? রাশেদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এবং মারিয়মকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মারিয়ম এইসব ব্যাপারে কিছুই জানতো না, অবশেষে রাশেদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এবং মারিয়মকে ধমকে চুপ করিয়ে দেয়।
তাদের চার বছরের বিবাহিত জীবনে মারিয়মের আরও ছয়টি গর্ভপাত হয় এবং মারিয়ম রাশেদকে আর খুশি করতে পারে না। মারিয়ম বুঝতে পারে যে সে একটি বোঝা হয়ে উঠেছে এবং রাশেদকে জিজ্ঞেস করে যে রাশেদ তাদের জীবনে কী ঘটাতে চায় কিন্তু রাশেদ কোনো উত্তর করে না।
২৭শে এপ্রিল রেডিওর মাধ্যমে তারা জানতে পারে বিদ্রোহী গ্রুপের ফোর্থ আর্মড ডিভিশন বিমানবন্দর দখল করে নিয়েছে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তাদের দখলে। বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ আক্রমণ করেছে। প্রেসিডেন্ট দাউদের সমর্থকরা পরাজিত হয়েছে। কয়েকদিন পর বিদ্রোহীরা তাদের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটায়, দাউদ খানের শাসনের ইতি ঘটায় এবং গুজব রটে যে বিদ্রোহীরা দাউদ খানের পরিবারের বিশজন সদস্যকে হত্যা করেছে। রেডিওতে খবর চলে একটি নতুন বিপ্লবী সংগঠন তৈরি হয়েছে এবং এখন এই দেশ পরিচিত পাবে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্থান নামে।
বিপ্লবের রাতেই ফারিবা ও হাকিমের ঘরে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, তারা তার নাম রাখে লায়লা।
রাশেদ মারিয়ামের রান্নার সমালোচনা করে এবং ভাত শক্ত হওয়ার কারণে রাশেদ মারিয়মকে পাথর চিবিয়ে খেতে বাধ্য করে। ফলে মারিয়ামের দাঁত ভেঙে যায়। রাশেদ মারিয়মকে বলে খারাপ খাবার ছাড়া মারিয়াম আর কিছুই তাকে দিতে পারেনি।
দ্বিতীয় খন্ড:-
প্রথম খণ্ডের সমাপ্তির নয় বছর পর দ্বিতীয় খন্ডটি শুরু হয়। সালটি ছিল ১৯৮৭। লায়লার বয়স তখন ৯ বছর। লায়লা হাকিম ও ফারিবার সন্তান। ঘুম থেকে উঠেই লায়লা তার বন্ধু তারিককে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে, যে ৩০ দিনের জন্য তার চাচার বাড়িতে গেছে গাজনি শহরে। নিচে লায়লার বাবা-মা আবারও ঝগড়ায় মেতে উঠেছে, এটি তাদের রুটিন মাফিক ঝগড়া। লায়লা স্মরণ করে একটা সময় ছিল যখন ফারিবা হাকিমকে মুগ্ধ করতেন, কিন্তু এখন তাদের সম্পর্ক টিকে রয়েছে শুধুই তর্কের ভিত্তিতে। লায়লার দুই সোভিয়েতের বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিয়েছে। লায়লা পুরো বিষয়টা জানে নিচে এখন কী ঘটছে। সে তার জুতো জোড়া নিয়ে মোছামুছি করে সেটাকে প্রস্তুত করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চুল ঠিক করে। লায়লার মা সবসময় তাকে বলেন সে তার মায়ের দাদীর মত সুন্দরী হয়েছে।
লায়লার বাবা খুব ছোটখাটো আলাভোলা একজন মানুষ। রাতের বেলা যখন সে বাবার ঘরে যায় তখন সে দেখতে পায় তার বাবা চোখের সামনে কোনো একটি বই ধরে তার মনোযোগ সহকারে পড়ছেন। অধিকাংশ সময়ই তিনি লায়লাকে লক্ষ্য করেন না অথবা লক্ষ্য করলে বইয়ের পৃষ্ঠা ভাঁজ করে তার দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দেন। লায়লা তার বাবার সাইকেলের পেছনে বসে স্কুলে যায়। সেদিন স্কুলে যাওয়ার সময় লায়লা লক্ষ্য করে জুতোর মিস্ত্রি রাশেদের বাড়ির সামনে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, যেটি মূলত হিরাত শহরের গাড়ি। এই ব্যাপারে সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলে তার বাবা জানায় এটা নিয়ে তার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সেদিন ক্লাসে লায়লা তার বন্ধু তারিকের অনুপস্থিতি আর বাবা-মার ঝগড়ার কারণে একটুও মনোযোগ দিতে পারেনা। শিক্ষক যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন রোমানিয়ার রাজধানীর নাম কী, তখন সে কিছুই বলতে পারে না। তাদের স্কুলে একজন শিক্ষিকা রয়েছেন যিনি লিঙ্গ সমতা এবং সোভিয়েত কমিউনিজম প্রচার করেন। শিক্ষিকা লায়লাকে "বিপ্লবী মেয়ে" হিসেবে উল্লেখ করেছেন কারণ তার জন্মদিন বিপ্লবের তারিখের সাথে মিলে যায়।
স্কুল থেকে বের হয়ে লায়লা তার দুই বান্ধবী হাসিনা আর গীতির সাথে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। হাসিনা তাদের উপদেশ দিচ্ছিল কীভাবে দেখতে বাজে স্বামীর থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। লায়লা হাসিনাকে জানিয়ে দেয় এই সব ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই। সে জানে তার বাবা তার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেন। তার বাবা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণ হওয়ার পরও রুটির ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। লায়লা অবশ্য হাসিনাকে এইসব ব্যাপারে কিছুই বলেনি। হাসিনা তাদেরকে জানাই খুব শিগগিরই তার ২০ বছরের বড় চাচাতো ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়ে যাবে। লায়লা গত দুবছর টার্ম পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছে, স্কুলের সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে, এই ব্যাপারেও সে হাসিনাকে কিছু জানায় না। কথা শেষ করে তারা যে যার বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। লায়লা যখন নিজের বাড়ির পথে উঠল তখন সে দেখে নীল রংয়ের গাড়িটা তখনো রাশেদ আর মারিয়মের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পথে খাদিম তাকে বিরক্ত করে। যখন তারেক অনুপস্থিত থাকে তখন সে লায়লার স্কুলের মাঠে কিংবা অন্যখানে এসে লায়লাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করে। লায়লা প্রচন্ড রেগে গিয়ে খাদিমকে লক্ষ্য করে খুব রুক্ষ ভাষায় প্রচলিত গালি দেয় এবং দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে। লায়লা মনে করে তার সাথে যদি তার মা উপস্থিত থাকতো তাহলে এই ধরনের ঘটনা তার সাথে ঘটতো না। লায়লার মাঝে মাঝে মনে হয় তার মা তাকে সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা লোকেদের যদি আগের কোনো সন্তান থাকে যাকে সে অনেক ভালবেসে ফেলেছে তাহলে তার আর সন্তান নেওয়া উচিত না। কখনো কখনো তার মায়ের ভালো দিন থাকে যেখানে তিনি তার নস্টালজিক সুখের প্রতিফলন করেন। রাশেদ এবং মারিয়মের সাজানো বিবাহের বিপরীতে লায়লার বাবা-মায়ের বিবাহ ছিল ভালবাসার বন্ধন। ফারিবা ভাবতেন যখন আফগানিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীন হবে তখন তার দুই ছেলেও যুদ্ধ থেকে ফিরে আসবে এবং তিনি তাদের বিয়ে দেবেন। লায়লার যখন ২ বছর বয়স তখন তার দুই ভাই আহমেদ এবং নুর কাবুল থেকে পানজশিরের উদ্দেশ্য রওনা দেয় আহমেদ শাহ মাসুদের বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য। তিনি আহমেদ ও নুরের লড়াইয়ের মুহূর্ত গুলি সংগ্রহ করতেন, যার মধ্যে গ্রামবাসী এবং শিশুদের উপর সোভিয়েত আক্রমণের খবরের অংশগুলো রয়েছে। ফারিবা সারাদিন বিছানায় থাকতেন এবং লায়লা যখন বলে যে ছেলেরা তাকে বিরক্ত করেছে তখন তার একটি উষ্ণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফারিবা প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি পরেরদিন লায়লাকে স্কুল থেকে আনতে যাবেন। লায়লা মারিয়ম ও রাশেদের বাড়ি থেকে নীল রঙের গাড়িটিকে চলে যেতে দেখে।
তারিক যখন প্রত্যাশিত সময় ফিরে আসে না লায়লা নিজের সময় কাটানোর জন্য নানাধরনের কাজ করতে শুরু করে। সে ধারনা করে তারিক হয়তো আবার কোনো ভূমি মাইনে আক্রান্ত হয়েছে। ১৯৮১ তে প্রথম সে মাইন বিস্ফোরণে আক্রান্ত হয়েছিল। তার বাবা-মা তাকে উত্তরের দিকে গাজনি তে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই যাত্রায় তারিক রক্ষা পেলেও তাকে তার একটি পা হারাতে হয়েছিল। অবশেষে একটি রাতে লায়লা দেখতে পায় তারিক ফিরেছে। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
পরদিন লায়লা তারিকদের বাড়ি যাওয়ার পথে রাস্তার মধ্যে খাদিম আর তার দলবলকে দেখতে পায়। তারা একটা লাঠি নিয়ে রাস্তার পাশে ময়লার মধ্যে কিছু একটা খোঁচাচ্ছিল। লায়লাকে দেখতে পেয়ে খাদিম লাঠিটা ময়লার মধ্যে গুঁজে দিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে তাকে বলে। লায়লা মাথা নিচু করে ছুটে চলে আসে ওখান থেকে। তারিকের বাড়িতে লায়লা তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে এবং তার চাচার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কথাবার্তা বলে। লায়লা তারিকদের বাড়িতে খাবার খেতে খুব পছন্দ করে, নিজের বাড়ির খাবারের থেকেও বেশি পছন্দ করে। তাদের বাড়ির সবকিছুই বেশ সুস্বাদু। খেতে খেতে তারা ধারাবাহিকভাবে প্রচুর কথা বলে। তারিক আর তার পরিবার যদিও গোঁড়া পাশতুন কিন্তু লায়লা যখন সামনে থাকে তখন তারা ফারসি ভাষায় কথা বলে লায়লার সুবিধার জন্য। কারণ লায়লা প্রাচীন পাশতুন বোঝেনা। লায়লার বাবা তাকে বলেছেন পাশতুন আর তাজিক গোত্রের মধ্যে খুব একটা সংঘাত আছে। তাজিকরা সংখ্যায় বেশি এবং তারা সব সময় পাশতুনদেরকে তুচ্ছ মনে করে। লায়লা কখনো তারিকদের বাড়িতে এই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করেনি। খাবার শেষ করে লায়লা এবং তারিক উপরের ঘরে যায়। সেখানে তারিক লায়লাকে তার ভ্রমণের বিষয় সম্পর্কে অনেক কথা শোনায়। তারিক লায়লাকে তার সাথে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং লায়লা তারিককে জানায় যে সে তাকে অনেক মনে করেছে। তারা যখন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপের কাছে আসে তখন লায়লা খাদিমকে দেখতে পায়। খাদিম লায়লাকে ভেঞ্চি কেটে কিছু একটা বলে। তখনই লায়লা তারিককে বিগত দিনের ঘটনা খুলে বলে এবং তারিক খাদিমকে মারধর করে।
ফারিবা তার পরিবারের সাথে খায় না। এদিকে হাকিম এবং লায়লা একসাথে খায় এবং হাকিম লায়লাকে তার বাড়ির কাজে সাহায্য করে। কমিউনিস্টরা হাকিমকে স্কুলে কাজ করা থেকে বরখাস্ত করে কিন্তু হাকিম এখনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে আশাবাদী, কারণ কমিউনিস্টরা নারীদের জন্য সাক্ষরতার উদ্যোগের দিকে মনোনিবেশ করেছে, ফলস্বরূপ, মহিলারা কাবুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ঘন ঘন ভর্তি হচ্ছে। ফারিবার পছন্দ না হওয়ায় হাকিম কমিউনিস্ট-পন্থী কথাবার্তা ন্যূনতম রাখে। কাবুল বরাবরই আফগানিস্তানের একটি প্রগতিশীল এলাকা, কিন্তু কাবুলের বাইরের সীমান্ত এলাকায় মেয়েদের শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তারা এখনও সেই আগের নিয়মেই চলছে। লায়লা ভাবে যে সে আজকে তারিকের সাথে খাদিমের যে ঘটনাটা ঘটেছে সে বিষয়ে তার বাবাকে বলবে। লায়লা সেই সুযোগ পায় না তার আগেই একজন অপরিচিত মানুষ তাদের দরজায় নক করে।
অপরিচিত ব্যক্তিটি খবর নিয়ে আসে যে আহমেদ এবং নুর জিহাদে মারা গেছে। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালন করা হয়। ফারিবা শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তিনি হাকিমকে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেন। ফারিবা রাতে আতঙ্ক এবং শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাই লায়লা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কোনো শারীরিক অসুস্থতা পাওয়া যায় না। লায়লা আরও কাজের জন্য দায়বদ্ধ হয়ে ওঠে এবং আশা করে যে ফারিবা অতীতে চিন্তা করার পরিবর্তে ভবিষ্যতের জন্য তার সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেবে। লায়লা অস্বস্তি বোধ করতে থাকে এই ভেবে যে তার মা আত্মহত্যা করবে,তাই সে তার মুখোমুখি হয়। ফারিবা বলেন যে তিনি আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু তার ছেলেদের জন্য তিনি একটি মুক্ত আফগানিস্তান দেখতে চান। লায়লা আহত হয় যে তার মা বলেনা যে সে তার জন্য বেঁচে থাকতে চায়।
হাকিম লায়লা ও তারিককে নিয়ে সারাদিনের জন্য ঘুরতে বের হয়। তারা হাসিনাকেও তাদের সাথে যেতে বলেছিল কিন্তু হাসিনার বাবা অনুমতি দেয়নি। লায়লার বাবা চালকসহ পুরো দিনের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করেন। যদিও তার বেতনের টাকা থেকে এটা বহন করা কষ্টসাধ্য ছিল কিন্তু তারপরেও তিনি এটি লায়লাকে জানতে দিতে চাননি। তারা ভোর পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে বের হয়। লায়লা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছিল। বাইরে তখন বরফ ঢাকা মরুভূমি গুলো আস্তে আস্তে গলতে শুরু করেছে আর বালুময় মরুভূমিতে রূপ নিচ্ছে। তারা বিখ্যাত দুই বুদ্ধের মূর্তির কাছে পৌঁছায় যেগুলো পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। ড্রাইভার তাদের জানায় আফগানিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরেও এগুলো পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাকিম স্বীকার করেন যে তিনি আহমেদ এবং নূরের মৃত্যুতে শোকাহত, তবে তিনি খোদার কাছে কৃতজ্ঞ যে তাকে লায়লার মত একজন মেয়ে দিয়েছেন। লায়লাই এখন তার সব। হাকিম আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেন কিন্তু তারা জানে ফারিবার কারণে এটা অসম্ভব হবে । লায়লা হাকিমকে বলতে চায় যে সে আফগানিস্তানে ছেড়ে যেতে চায় না কারণ সে তার বন্ধুদেরকে এবং তারিককে অনেক বেশি মনে করবে।
১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, নয় মাসের মধ্যে তারা চলে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে আর কোনো সোভিয়েত থাকবে না। কিন্তু ফারিবা এতে সন্তুষ্ট হয় না। তিনি বলেন, সোভিয়েত শাসন তো এখনই শেষ হচ্ছে না। তাদের পুতুল সরকারও কোথাও যাচ্ছেনা। তাই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না।
পরের বছর লায়লা তার পরিবার আর হাসিনার সাথে শহর থেকে সোভিয়েতের শেষ সেনা বহরটা চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে যায়। সেনাবাহিনীর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য কৌতুহলী লোকজন রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ভিড় করেছিল। আফগান সৈন্যরা রাস্তার মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, মাঝে মাঝে তারা সতর্ক করার জন্য বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করছিল। ফারিবা তার মাথার ওপর দুই ছেলে আহমেদ আর নুরের ছবি উঁচু করে ধরে রাখেন। তার মতো অন্য মহিলারাও তাদের শহীদ হয়ে যাওয়া সন্তান, স্বামী, বাবার ছবি উঁচু করে ধরে রাখে।
এর কয়েক বছর পর তারিকের বাবা আবার স্ট্রোক করেন। ১৯৯২ সাল নাগাদ তারিখের বাবার একাধিক স্ট্রোক হয় যা তার কথাবার্তা এবং গতিশীলতাকে ব্যাহত করে।
হাসিনা তার বিয়ের জন্য পরিবারের সাথে লাহোর রওনা দেয়। যেদিন সে গীতি এবং লায়লার থেকে বিদায় জানাতে আসে সে তাদেরকে জানায় যে তার চাচাতো ভাই যার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে সে জার্মান যাওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করছে এবং খুব শীঘ্রই তারা জার্মান রওনা দেবে।
খুব দ্রুত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে শুরু করে। প্রতি সপ্তাহে হাকিম নতুন নতুন খবর নিয়ে আসতেন। নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি হয়। সরকার নতুন কৌশল অবলম্বন করেন, প্রমাণ করতে চায় যে তিনি একজন খাঁটি মুসলিম। নাজিবুল্লাহ সরকার মুজাহিদিনদের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেন কিন্তু মুজাহিদিনরা তা ফিরিয়ে দেয়। ফারিবা মুজাহিদিনদের বিজয় প্যারেড দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি তার ছেলেদের শত্রুর পতন দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
১৯৯২ সালের এপ্রিল মাস, এই বছর লায়লা ১৪ বছরে পূর্ণ হয়, নাজিবুল্লাহ আত্মসমর্পণ করেন। লায়লার জন্মের রাত থেকে শুরু হওয়া কমিউনিস্ট রাজত্ব শেষ হয়, জিহাদের অবসান ঘটে। একটি কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তান ইসলামিক স্টেট হয়ে ওঠে, পরে অন্যান্য কাউন্সিল এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। স্বাধীনতার জন্য পরিবার ছেড়ে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়ে যে মুজাহিদিনরা যুদ্ধ করছিল তারা বাড়ি ফিরতে শুরু করে; ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, রক্তাক্ত অবস্থায় তারা কাবুলে ফিরে আসে। এতদিনে লায়লার মায়ের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। তিনি এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, তিনি মনে করেন এখন তার ছেলেরা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। ফারিবা শোক থামিয়ে উৎসব করেন। তিনি লায়লার সাথে তার এবং তারিকের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেন। লায়লা জানায় যে তারিক তার ভাইয়ের মতো। বলার পরেই লায়লা অনুভব করে যে সে আসলেই তারিকের প্রেমে পড়েছে। ফারিবা লায়লাকে তার এবং তারিককে নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে সতর্ক করেন।
গীতি জানায় সাবির নামের একটি ১৮ বছরের ছেলেকে তার ভালো লেগেছে এবং সে তাকে বিয়ে করবে বলে আশা করছে। লায়লা তারিকের প্রতি কম মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু গোপনে সে তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। তারিকের মা তারিকের দিকে লায়লার গোপন দৃষ্টিতে সম্মতি দেন। তারিক ধূমপান করা শুরু করে এবং নতুন বন্ধু তৈরি করে, যা লায়লা ঘৃণা করে।
একদিন রাতে যখন লায়লা বিছানায় শোয় তখন সে জানালার ভেতর দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র আলোক ছটা দেখতে পায়, শুনতে পায় বাইরে ক্রমাগত বন্দুকের গুলির শব্দ। তাদের বাড়ির ছাদ কাঁপিয়ে যে রকেট সেলগুলো উড়ে যাচ্ছে সেগুলো গুনতে থাকে। কোনো কোনো রাতে রকেট গুলোর বিস্ফোরণে এত তীব্র আলো হয় যে সে আলোতে বই পড়া যাবে। আর এই সমস্ত কারণে লায়লার রাতের ঘুমের স্বপ্নগুলো বন্দুকের শব্দ আর আহত মানুষদের তীব্র চিৎকারে পূর্ণ থাকে। ভোর হয় কিন্তু শান্তি আসেনা। মুজাহিদিনরা বন্দুক রেখে নামাজে দাড়ায়।তারপর আবার বন্দুক গুলি দিয়ে ভর্তি করা হয় আর কাবুলের ওপাশে পাহাড়ি অঞ্চলের ওপর গুলি বর্ষিত হয়। লায়লা কখনো একা বাইরে বের হয়না। যখনই বের হয় তার সাথে তারিক থাকে। তারিক একট বন্দুক কিনেছে যা সে লায়লাকে দেখায়। কিন্তু লায়লা তাকে জানায় যে সে বন্দুক পছন্দ করে না। তারিক লায়লাকে জানায় বিশ্বাসঘাতক যোদ্ধারা কাবুলের চারপাশ দিয়ে সীমান্ত তৈরি করেছে। নানা প্রকার যোদ্ধাদের দল ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দল তৈরি করে ভিন্নস্থানে আস্তানা গেড়েছে। তারিক বন্দুকটি কোমরের খাঁজে রেখে লায়লাকে খুব চমৎকার একটা কথা বলে যে সে লায়লার জন্য যে কাওকে খুন করতে পারে।
সেই বছর ১৯৯২ এর জুন মাসে পশ্চিম কাবুলে পাশতুন গোত্র আর হাজারা গোত্রের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। রকেট সেলগুলো মানুষের বাড়িঘর দোকানপাট সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। লায়লা জানতে পারে পাশতুন সৈন্যরা হাজারাদের বাড়িঘর আক্রমণ করে তাদের পরিবারকে হত্যা করছে। অন্যদিকে হাজারা গোত্র পাশতুনর ওপর আক্রমণ করে তাদের মেয়ে ও স্ত্রীদের ধর্ষণ করে হত্যা করছে। হাকিম আবার ফারিবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা কাবুল ছাড়তে চায়। কিন্তু ফারিবা এতে রাজি হয় না।
রাস্তা গুলো ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। লায়লার বাবা তাকে স্কুলে পাঠানো নিরাপদ মনে করেন না। তিনি নিজেই লায়লার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন।
জুন মাসের এক সময় গীতি স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি রকেট তাদের ওপর আছড়ে পড়ে এবং গীতি মারা যায়। গীতি ছিল লায়লার জীবনের প্রথম মানুষ যাকে সে এত কাছ থেকে মারা যেতে দেখেছে। সে তার বন্ধুর জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে।
১৯৯২ এর গরম দুপুর। লায়লা আর তারিক তাদের শোয়ার ঘরে বসে গল্প করছিল। তারিক লায়লাকে জানায় সে খুব শিগগিরই আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবে। তার বাবা এই যুদ্ধ আর হত্যার চাপ সহ্য করতে পারছেন না। লায়লা তার মুখটা ঢেকে ফেলে। তার বুকের ভেতর কষ্টের দানাগুলো উপচে পড়তে থাকে। সে কাঁদতে শুরু করে, হাত দিয়ে তারিককে আঘাত করতে শুরু করে। তারিকের কিছুই করার ছিল না। সে আস্তে করে লায়লার কোমরটা ধরে তাকে কাছে টেনে নেয় এবং তার ঠোঁটে চুম্বন করে। এরপর তারা পূর্ণাঙ্গভাবে একে অপরের সাথে মিশে যায়। কয়েক মুহূর্ত পরে তারা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তারিক লায়লাকে তার সাথে পাকিস্তানে এসে তাকে বিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। লায়লা চলে যেতে চাই কিন্তু সে বুঝতে পারে তার বাবার জীবন শেষ হয়ে যাবে যদি সে পরিবার ছেড়ে চলে যায়। তারিক এই প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিল এবং লায়লা তারিককে বিদায় না দিয়ে চলে যেতে বাধ্য করে। তারিক সদর দরজার বাইরে থেকে চিৎকার করে বলে যে সে লায়লার জন্য ফিরে আসবে।
লায়লা তারিকের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া নিয়ে দোষী বোধ করতে থাকে, কিন্তু একই সাথে সেই সুন্দর মুহূর্তগুলোকে মনে রাখার চেষ্টা করে। এদিকে হাকিম জানায় তারা কাবুল ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যাবে। গীতির মৃত্যুর পর যখন আরও হাজার হাজার রাউন্ড গুলি গীতিদের বাড়ির উপর আছড়ে পড়েছিল তখন তার মার হুঁশ হয়। তিনি তার দুই সন্তানকে হারিয়েছেন, এখন যে একটা সন্তান আছে তাকে হারাতে চাননা। তারা অল্প কিছু জিনিসপত্র প্যাক করে এবং বাকি জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়। প্যাকিং করার সময় লায়লাদের বাড়িতে একটি বোমা আঘাত করে। খুব গরম ও শক্তিশালী কিছু যেন তার মুখে আঘাত করে। আঘাতে তার পায়ের স্যান্ডেল উড়ে যায়। সে ছিটকে একটি প্রাচীরের ওপর আছড়ে পরে, শরীর রক্তে ভেসে যায়। সে অন্ধকারে ডুবে যায়। লায়লা মনে করে সে কোনো স্বপ্ন দেখছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তারপর সব জায়গায় দীর্ঘ এক নীরবতা।
বাকি অংশ দ্বিতীয় পর্বে
4:00 AM, September 01, 2022