4:00 AM, October 21, 2024
A THOUSAND SPLENDID SUNS
(দ্বিতীয় পর্ব)
KHALED HOSSEINI
তৃতীয় খণ্ড:
বোমার আঘাতে লায়লাদের বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে ছিটকে এসে একটি দেওয়ালে ধাক্কা খায়। লায়লার যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে রাশেদ ও মারিয়ামের বাড়িতে। রাশেদই তাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে। লায়লা তার একটি কানের শ্রবন শক্তি হারায়। প্রথম সপ্তাহে সে কিছুটা ঘুমিয়ে কাটায়। রাশেদ তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘুমের মাঝেই লায়লা মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতো, মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠতো, উত্তেজিত হয়ে বালিশ কম্বল সবকিছু ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতো। মারিয়ম তাকে চেপে ধরে রাখত। যখন সে শান্ত থাকতো তখন কম্বলের নীচে থেকে নিরীহ দুটি চোখ দিয়ে ছোট ছোট শ্বাস নিতে নিতে রাশেদের কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করত।
রাশেদ একদিন লায়লাকে জানায় তার বন্ধু তারিকের বাড়ি এখন দখল হয়ে গেছে। তিনজন লোক সেটাকে দখল করেছে। তারপর একদিন সকালে সে বাড়ির উপর রকেট আঘাত করে, বাড়িটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ছেলেগুলোর ছিন্নভিন্ন শরীর এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকে।
যেই বিস্ফোরনে লায়লা তার বাবা মাকে হারিয়েছিল তার ঠিক একমাস পর আব্দুল শরীফ নামে একজন লোক তার খোঁজ করতে রাশেদের বাড়িতে আসে। সে লায়লার সাথে দেখা করে তাকে তারিকের মৃত্যুর খবর জানায়। সে জানায় তারিক একটি লড়িতে করে পেশোয়ারের দিকে শরণার্থী শিবিরে যাচ্ছিল। রাস্তার মধ্যে যখন তারা সীমান্ত এলাকায় চলে আসে তখন মোজাহিদিনদের ক্রসফায়ারে পড়ে যায়। একটা রকেট এসে লরিটাকে আঘাত করে। অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই মারা যায়। তারিক সহ আরো কিছু ব্যক্তিকে খুব গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আব্দুল শরীফ সেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তার পাশের বিছানাতেই তারিককে রাখা হয়। লোকটি জানায় তারিক তাকে লায়লার কথা জানিয়েছে। তারিখ খুব সাহসের সাথে লড়াই করে মারা যায়। লায়লার যেন মনে হয় সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। তার মনে পড়ে এরকমই একদিন একজন লোক তার মায়ের কাছে তার দুই ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এসেছিল। লায়লা শূন্য দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে চেয়ারের উপর বসে থাকে এবং কল্পনা করতে থাকে অবারিত সবুজ ক্ষেত, নিরব শান্ত চারপাশ। তার বাবা বসে বসে বই পড়ছে আর সে ঝরনার মধ্যে পা ছড়িয়ে বসে আছে।
এর কিছুদিন পর রাশেদ মারিয়ামকে জানায় সে লায়লাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু মারিয়াম এর তীব্র বিরোধিতা করে। রাশেদ মারিয়মকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে বাইরের দুর্যোগ পরিবেশ একজন অবিবাহিত সুন্দরী তরুণীর জন্য ঠিক না। আশেপাশের লোকজন খারাপ নজরে দেখছে। রাশেদ জানায় এই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে একটা মেয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সে লায়লাকে তা দেবে। পরে মারিয়াম লায়লাকে সবকিছু খুলে বলে এবং লায়লা বিয়েতে সম্মতি দেয়।
পরদিন রাশেদ বাইরে যাওয়ার আগে লায়লার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে বলে যায় যে সে নাপিতের দোকানে যাচ্ছে চুল কাটানোর জন্য। ফিরে এসে সে লায়লাকে তার নতুন চুলের কাট দেখায়, নতুন জামা দেখায়। এরপর লায়লার বিছানার পাশে বসে তাকে একটি বিয়ের আংটি উপহার দেয়।
আব্দুল শরীফের সাথে যোগাযোগ হওয়ার পর লায়লা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে পাকিস্তান চলে যাবে। এমনকি আব্দুল শরীফ যখন তাকে সেই খারাপ সংবাদটা দিল তখনও সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যেভাবেই হোক এই পোড়ো শহর ছেড়ে সে চলে যাবে, যে শহরের রাস্তার প্রতিটি কোনায় কোনায় মৃত্যু ফাঁদ থাকবে না। তার জীবনে প্রচুর মানুষের আনাগোনা হয়েছে, যারা শুধু তার জন্য ভয়ানক দুঃখই নিয়ে এসেছে। তার দুই ভাই আহমেদ ও নুর মারা গেল, হাসিনা চলে গেল, গীতি মৃত। মা বাবা দুজনেই মারা গেছেন। এমনকি তারিকও চলে গেল। কিন্তু অলৌকিকভাবে হলেও এখনো কিছু তার মধ্যে অবশিষ্ট আছে। তারিকের একটি অংশ এখনো তার মধ্যে বেড়ে উঠছে। তারিক গেছে ছয় সপ্তাহ হয়েছে তাই রাশেদের মনের ভেতর এই অল্প সময়ের ভেতর সন্দেহ তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লায়লা জানে সে যেটা করতে যাচ্ছে এটা খুব খারাপ আর অসৎ একটা কাজ। খুবই লজ্জাজনক একটি কাজ। মারিয়মের প্রতিও তার এই কাজটা করা কিছুটাই ঠিক হবে না। কিন্তু তার শরীরের ভেতর যেই ছোট্ট প্রাণটা বেড়ে উঠছে তার জন্য তাকে এটা করতেই হবে।
বিয়ের অনুষ্ঠানের সবকিছুই লায়লার মনে থাকবে। রাশেদ ক্রিম রঙের রেখা টানা একটি পোশাক পড়েছিল। যখন সে লায়লাকে আংটি পড়াচ্ছিল তখন সে দেখে রাশেদের সিগারেট খাওয়া পোড়া রুক্ষ আঙ্গুল। সই করার জন্য যে কলমটা দেওয়া হল তাতে কালি ছিল না। পরে অন্য একটি কলম আনা হয়। বর কনের মুখ দেখার জন্য যখন আয়না আনা হল তখন লায়লা লক্ষ্য করে রাশেদ তার ভ্রুটা নাচাচ্ছে।
সে রাতে রাশেদের ঠান্ডা বিছানায় শুয়ে লায়লা লক্ষ্য করে রাশেদ মশারি গুঁজে দিচ্ছে। যখন রাশেদের হাত তার জামার বোতাম খোলার চেষ্টা করছিল তখন লাইলার পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। রাশেদ খুব উত্তেজিত ছিল। সে দ্রুত নিজের শার্ট খোলে,পাজামা খোলে। লায়লা পরিপূর্ণভাবে বুড়ো রাশেদকে দেখে। রাশিদের বুক কোঁচকানো, কাঁধটা অনেক প্রসারিত, নিচের পেটটা অনেকটা ঝোলা এবং বুকের মধ্যে অসংখ্য সাদা পাকা লোম। লায়লা লক্ষ্য করে রাশেদ ক্ষুধার্ত চোখে তাকে দেখছে।
পরে লায়লা যখন নিশ্চিত হয় রাশেদ ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে আস্তে করে বিছানা থেকে নিচে নামে এবং ঘরের গোপন একটি জায়গা থেকে ছুঁড়ি বের করে তার নিজের হাতের আঙ্গুলের একটি অংশ কেটে রক্ত বের করে। রক্তসহ সেই কাটা আঙ্গুল নিয়ে যেই বিছানায় তারা একসাথে শুয়ে ছিল তার চাদরে মাখায়।
লায়লা ও মারিয়ামের মধ্যে একটি ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। যখন বাড়ির সরু জায়গাটা দিয়ে তারা মুখোমুখি হয়ে একজন আরেকজনকে অতিক্রম করে যেত তখন তাদের মধ্যে একটি বাড়তি উত্তেজনা এবং অস্বস্তি কাজ করত। মারিয়ম লায়লার শরীর থেকে রাশেদের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করত। রাশেদ বলেছিল তারা একটি পরিবার। বেশ জোর দিয়েই বলেছিল যে তারা একটি পরিবার আর তারা একসাথেই সব সময় খাবার খাবে।
রাশেদ লায়লাকে বলে সে এখন তার স্বামী। এখন তার একমাত্র দায়িত্ব হল তাদের মান মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করা। এটাই একজন স্বামীর একমাত্র দায়িত্ব। আর লায়লা এই বাড়ির রানী,মালকিন আর এই বাড়িটা হল রাজপ্রাসাদ। লায়লার যখনি যা প্রয়োজন হবে মারিয়াম তাকে সেটা প্রস্তুত করে দেবে। পরে মারিয়াম লায়লাকে জানিয়ে দেয় সে তার চাকর হতে পারবেনা এবং ঘরের সব কাজ তাদের দুজনকেই ভাগাভাগি করে করতে হবে। লায়লা সবকিছুর জন্য মারিয়ামের কাছে ক্ষমা চায়।
এর কিছুদিন পর লায়লা রাশেদকে বাচ্চা হওয়ার খবর দেয়। খবর শোনার সাথে সাথে রাশেদ মসজিদের দিকে যায় এবং একটি ছেলের জন্য প্রার্থনা করে। এর আগে লায়লা কখনোই রাশেদকে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখেনি।
রাশেদ বাইরের পৃথিবীর যুদ্ধের সব খোঁজ খবর বাড়িতে নিয়ে আসতো এবং লায়লা ও মারিয়ামকে বুঝিয়ে বলতো। কাবুল বিশেষ করে পশ্চিম কাবুলের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। সেখানে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়, স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, অ্যাম্বাসিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, হাসপাতালের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় এবং কেউ আহত হলে রক্তপাত হতে হতে সে মারা যায়। রাশেদ লায়লাকে আশ্বস্ত করে বলে যে সে তার কাছে খুবই নিরাপদ।
১৯৯২ এর শীতকাল টা লায়লা বাড়ির ভেতর হাঁটাহাঁটি করেই পার করে। কখনো শোয়ার ঘরের রং পাল্টায় আবার কখনো কাপড় পরিষ্কার করে। যখন বরফ পড়া খুব বেশি বেড়ে গেল আর বাইরে যাওয়া একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ল তখন একদিন সে ছুটে মারিয়ামের সাথে দেখা করার জন্য রান্নাঘরে যায়। মারিয়ম তার দিকে নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়। লায়লা বুঝতে পারে নিরব একটা শত্রুতা এখনো তাদের মধ্যে রয়ে গেছে। লায়লা আবার তার নিজের ঘরে ফিরে আসে এবং জানালার পাশে বসে বরফ ঝরা দেখতে থাকে।
রাশেদ একদিন লায়লাকে তার নিজের জুতোর দোকানে নিয়ে যায়। তারা বের হয়ে পাশাপাশি হাঁটে। একটি হাত দিয়ে রাশেদ তার কনুইটা ধরে রেখেছিল। বোরখা পড়ে হাঁটা লায়লার জন্য খুব কষ্টকর ছিল কারণ এর পূর্বে সে কখনোই বোরখা পড়েনি। এতে অবশ্য লায়লা একটি সুবিধা খুঁজে পায়। কেউ তাকে চিনতে পারবে না এবং বুড়োর সাথে বের হয়েছে বলে কোনো আশঙ্কা বা লজ্জারও ব্যাপার থাকবে না।
রাশেদের দোকানটি ছিল চাকচিক্যে ভরা। রাশেদ তাকে দোকানের সবচেয়ে ভালো আসনটিতে বসতে দেয়। রাশেদ যখন তার পেট স্পর্শ করে লায়লার মনে হয় খুব রুক্ষ একটি হাত তাকে স্পর্শ করেছে। লায়লা তারিকের কথা মনে করে, তার হাত ছিল খুব নরম এবং শক্তিশালী।
১৯৯৩ এর বসন্তের শেষে এক সকালে মারিয়ম ঘরের জানালা দিয়ে লক্ষ্য করে রাশেদ খুব ব্যস্ত হয়ে লায়লাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে। লায়লা তার কোমর ও পেট ধরে রেখেছে। রাশেদকে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। সে খুব আস্তে আস্তে ট্রাফিক পুলিশের মত লায়লাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
পরদিন বিকেলে তারা ফিরে আসে। রাশেদ প্রথমে উঠোনে ঢোকে। বাড়িতে ঢোকার সময় সে দরজাটা এমন ভাবে খোলে যে পেছনে মেয়েটার মুখের ওপর তা আঘাত করে। রাশেদ দ্রুত কয়েক পদক্ষেপ উঠোন পার হয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। মারিয়ম লক্ষ্য করে রাশেদের মুখটা খুব গম্ভীর। মারিয়ম লক্ষ্য করে নিচে লায়লা তখন তার কোলে একটি কাপড়ের পুটলি দিয়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে সেটা নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছে। বাড়ির মূল দরজাটা বন্ধ হওয়ার আগে সেটাকে এক পা দিয়ে সে আটকে রেখেছে যাতে দরজাটা বন্ধ না হয়ে যায়। লায়লা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। ফলে রাশেদ তার ওপর ক্ষেপে আছে।
মারিয়াম কখনোই শোনেনি রাশেদ তার মেয়েকে নাম ধরে ডাকছে। মেয়ের নাম দিয়েছে সে আজিজা। যখনই সে তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে তখনই বলে এই বাচ্চাটা কিংবা এই বস্তু। কখনো কখনো লায়লা আর রাশেদের মধ্যে রাতের বেলা তর্ক বিতর্ক হয়। মারিয়াম পা টিপে টিপে রাশেদের ঘরের দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করে তারা কি বলছে।
এরপর থেকে প্রতিরাতেই রাশেদ ও লায়লার মধ্যে কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকতো। সে রাতেও মারিয়াম বিছানায় সবেমাত্র শুয়েছে তখন লায়লার সাথে রাশেদের ঝগড়া শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর রাশেদ খুবই বিকট শব্দে মারিয়ামের ঘরের দরজা খোলে। তাকে খুবই ক্ষিপ্র দেখাচ্ছিল। সে হাতে একটি চামড়ার বেল্ট পেঁচাতে পেঁচাতে মারিয়ামের ঘরে ঢোকে। অনেক বছর ধরে রাশেদের অত্যাচার আর বাজে কথা শুনতে শুনতে মারিয়াম নিজেকে শক্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু রাশেদ সেই দিন যে উগ্রমূর্তি ধরে এসেছিল সেটা সত্যিকার অর্থেই খুব ভয়ংকর ছিল। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছিল। রাশেদ মারিয়াকে দোষ দিতে থাকে। সে বলতে থাকে মারিয়ামই লায়লাকে শিখিয়েছে কিভাবে স্বামীর অবাধ্য হতে হয়,স্বামী কিছু চাইলে কিভাবে সেটা অস্বীকার করতে হয়। লায়লার অনেক আকুতি মিনতি সত্ত্বেও রাশেদ মারিয়ামকে মারতে থাকে। তখনই লায়লা হঠাৎ করে রাশেদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেক অনুনয়ের পর রাশেদ শান্ত হয় এবং তাদেরকে হুমকি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সেই রাতে মারিয়ামে তিনবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলে। প্রথমবার জেগে ওঠে যখন বাড়ির উপর দিয়ে বিকট শব্দ করে রকেট সেলগুলো উড়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয়বার জাগলো বাচ্চাটার কান্নার শব্দ শুনে। লায়লা তাকে দুধ খাইয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। তৃতীয়বার সে ঘুম থেকে ওঠে তীব্র পানির পিপাসা নিয়ে। পানি খাওয়ার জন্য মারিয়াম রান্নাঘরে ঢোকে। ঘরটা ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মনে হয় অন্ধকারে তার পায়ের সাথে কারো পা ঠেকলো। অন্ধকার সয়ে আসার পর সে দেখে রান্নাঘরের মেঝেতে বিছানা করে লায়লা তার মেয়েকে নিয়ে শুয়ে আছে।
লায়লা মরার মতন ঘুমিয়ে নাক ডাকছে আর পাশে মেয়েটি জেগে আছে। সে নিজের মতো খেলছে। মারিয়াম একটি কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে বাতিটি নিচে নামিয়ে রাখে। প্রথমবারের মতো সেই লায়লার মেয়েকে এত কাছ থেকে দেখে। গাড়ো ভ্রু ওয়ালা দুটো চোখ, কালো চুল, বেদনার মতন লাল টকটকে ঠোঁট। মারিয়ম অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে বাচ্চাটাও তাকে দেখছে। বেশ সন্দেহ পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মারিয়ম ভয় পাচ্ছিল যে বাচ্চাটা হয়তো তাকে দেখে ভয় পাবে, কিন্তু বাচ্চাটা তাকে বেশ আন্তরিক ভাবেই গ্রহণ করে। মারিয়ম বাচ্চাটার শরীরের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে দিয়ে ওর কাপড়টা একটি হালকা করে দেয়। শিশুটি আরাম পেয়ে গরররররররররর শব্দ করতে থাকে। মারিয়াম বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ঝুলিয়ে নেয়। বাচ্চাটা তখন আবার খুশিতে হাসতে শুরু করে। মারিয়াম বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়ে একটু শান্ত করে ঘুম পাড়ানোর জন্য হাঁটতে লাগে,মেয়েটা তখনও শব্দ করেই যাচ্ছিল।
লায়লার ভালো লাগে তার ছোট্ট মেয়ে আজিজার পাশে শুয়ে থাকতে। এতটা কাছে যাতে করে মেয়েটার চোখের তারা,পাপড়ি সবকিছু অনেক ভালোভাবে দেখা যায়। লায়লার ভালো লাগে তার মেয়ের নরম ত্বকের উপর দিয়ে তার আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে। কখনো কখনো লায়লা আজিজাকে তার বুকের ওপর শুইয়ে দেয় এবং ফিসফিস করে তারিকের গল্প বলে। আজিজার আসল বাবা যে তার কাছে সব সময় অপরিচিত, যার চেহারাটা আজিজা কখনো দেখতে পারবে না। লায়লা তার মেয়ের কাছে তারিকের বিষয়ে বলে যে সে দেখতে কত সুন্দর ছিল, তার হাসিটা ছিল কত মুগ্ধকর আর সহজ সরল। লায়লা যখন এ বিষয়ে কথা বলে তখন ভুলেও সে তারিকের নাম উচ্চারণ করে না। মাঝে মাঝে লায়লা লক্ষ্য করে রাশেদ খুব অদ্ভুত আর সন্দেহের চোখে মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে। একদিন রাশেদ লায়লাকে জিজ্ঞেস করে তার এবং তারিকের মধ্যে আসল সম্পর্কটা কেমন ছিল। উত্তরে লায়লা জানায় সে তার বন্ধু ছিল। রাশেদ তীব্র চোখে লায়লার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আঁচ করার চেষ্টা করে। লায়লা রাশেদের চোখ দেখে ভয় পেয়ে যায়। লায়লা ভাবছিল কোনো কিছু কী ধরা পড়ে গেছে বা তার চুরির বিষয়টা কী রাশেদ টের পেয়ে গেল।
প্রতি সপ্তাহে আজিজার জন্মের পর থেকে লায়লা রাশেদের টাকার থলি থেকে কিছু কিছু করে টাকা সরিয়ে রাখত। রাশেদ যখন ঘুমিয়ে থাকত কিংবা টাকার থলিটা ঘরে রেখে বাইরে যেত তখন সে কিছু টাকা সেখান থেকে নিয়ে নিতো। কোনো সপ্তাহে টাকার থলিটা যদি হালকা থাকত তখন লায়লা সেখান থেকে মাত্র ৫ আফগানি মুদ্রা নিয়ে থলিটা রেখে দিত আর যদি কখনো থলিটা ভারী লাগত তখন সে বিশটা মুদ্রা কিংবা তার চেয়ে বেশি মুদ্রা সরিয়ে রেখে তার চামড়ার যে শীতকালীন পোশাকটা আছে তার ভেতরে লুকিয়ে রাখত। লায়লা সামনের বসন্তে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সে আফগানি পাকিস্তানের পেশোয়ারের দিকে রওনা দেবে। লায়লা তার বিয়ের আংটিটা সরিয়ে রাখে। শুধু তাইনা রাশেদ যখন তাকে রানী বলে মনে করত তখন সে লায়লাকে অনেক অলংকার দিত, সেগুলোও লায়লা সরিয়ে রাখে।
দুইদিন পর লায়লা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তার ঘরের সামনে শিশুদের কাপড়ের নানা রকম পদের স্তূপ। বিভিন্ন রকমের পাজামা, তার সাথে মিল রেখে মোজা আরো অনেক কিছু। লায়লা মারিয়মকে ধন্যবাদ জানাই পোশাকগুলোর জন্য।
মারিয়াম প্রথমবারের মতো পূর্ণ চোখে লায়লার দিকে তাকায়, সেই চোখে কোনো ঘৃণা ছিল না, ছিল এক ধরনের অসহায় ভাব। অন্যান্য রাতগুলোতে রাশেদ যখন মারিয়ামকে মারতে আসতো তখন কেউ তার সামনে দাঁড়াতো না তাকে রক্ষা করার জন্য। লায়লা মারিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়। সে মারিয়ামকে জানায় যে সে কখনোই রাশেদকে এই কাজ করতে দেবে না। যেই ঘরে ঘরের মালিক এই রকম আচরণ করে বেড়ায় সেখানে সে কিছুতেই থাকবে না।
তারা দুজনে বাইরের চেয়ারে বসে একই প্লেট থেকে হালুয়া নিয়ে খাচ্ছিল। অনেক দূরে পাহাড়ের ওপর থেকে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ হচ্ছিল। ঘরে আজিজা যখন ঘুম থেকে জেগে উঠলো তখন রাশেদ চিৎকার করে লায়লাকে ডাকতে থাকে আজিজাকে শান্ত করার জন্য। লায়লা উঠে যাওয়ার সময় মারিয়ামের দিকে তাকালো। একে অপরের দৃষ্টি থেকে তারা বুঝে নেয় তারা শত্রু না, তারা এখন বন্ধু।
সেই রাত থেকে মারিয়াম এবং লায়লা একত্রে তাদের ঘরের কাজগুলো করতে থাকে। উঠোনে তখন আজিজা একটি বেতের ঝুড়ির দোলনায় শুয়ে থাকে। মারিয়াম আর লায়লা কাজ করতে করতে খুব সতর্ক দৃষ্টিতে আজিজাকে দেখতে থাকে। মারিয়াম ধীরে ধীরে এই আনন্দময় সময়ের সঙ্গে এক হয়ে যেতে থাকে। সকালে মারিয়াম অপেক্ষা করে কখন লায়লা তার বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে আসবে। তার কোলে আজিজা খল খল করে হাসতে থাকবে, ছোট ছোট দাঁতগুলো তাকে দেখাবে। আজিজার শরীরের দুধ দুধ গন্ধটা মারিয়ামের খুব ভালো লাগে। লায়লা আর আজিজা যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে মারিয়াম খুব অস্থির হয়ে পড়ে কেন তারা নিচে নামছে না এই চিন্তায়। সে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। আজিজা সকালে যখন মারিয়ামকে প্রথম দেখে তখন মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করতে থাকে আর তার মায়ের কোলে হাত পা ছুড়ে মারিয়ামের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় তার কোলে যাওয়ার জন্য। আজিজা মারিয়ামের কোলে উঠেই তার মুখটা মারিয়ামের কাঁধে হেলিয়ে দেয়। মারিয়াম ছোট্ট মেয়েটার পিঠে হাত বোলাতে থাকে। এই ধরনের ভালোবাসা সে কখনো প্রত্যাশা করেনি,তার চোখ দুটো ভিজে ওঠে।
১৯৯৪ এ জানুয়ারিতে কাবুল নদীর এপার ওপার দুইপারেই অস্ত্র সমাগম হতে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল, বাড়ি দোকানে হাটেবাজারে বিশৃঙ্খলা লেগে যায়, যোদ্ধারা গণহারে ধর্ষণ করতে শুরু করে, লুট রাজ হানাহানি চরম পর্যায়ে চলে যায়। মেডিকেল আর হাসপাতালে আহত লোকের জায়গা দেওয়ার মত অবস্থা নেই। জরুরী খাদ্য পরিবহনের গাড়িগুলো নগরীতে ঢুকতে পারছে না। মারিয়াম মোল্লা ফয়জুল্লাহ, বিবি জো এবং জলিলের কথা চিন্তা করে। মারিয়াম ভাবে জলিল কী লুকিয়ে থাকবেন নাকি তার সন্তান স্ত্রীদের নিয়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় বা দেশে চলে যাবেন। মারিয়াম মনে প্রাণে আশা করছিল তার বাবা যেন ভালো থাকে।
অতিরিক্ত আক্রমনের কারণে রাশেদ এক সপ্তাহ ঘরের বাইরে বের হল না। সে বাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে বাড়ির মূল ফটকের সামনে ফাঁদ তৈরি ঘরের ভেতর তার বন্দুকটা নিয়ে বসে থাকতো। বারবার বন্ধুক পরিষ্কার করত। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতো যেন বাইরে থেকে কিছু বোঝা না যায়।
সেই বছরই এক শীতে লায়লা, মারিয়ামের চুলের বেনী বাঁধছিল। মারিয়াম স্থির হয়ে বসে আয়নার মধ্যে চিকন আঙুলগুলো দিয়ে চুলের বেনী কাটা দেখছিল আর আজিজা উবু হয়ে মেঝের উপর শুয়ে ছিল। একসময় হঠাৎ করে মারিয়াম নিজের জীবনের অতীতের ঘটনা বলা শুরু করে। সেই রাতে লায়লা মারিয়ামকে জানায় যে এই বসন্তেই সে আর আজিজা পালাচ্ছে এবং সে মারিয়াম কেও তাদের সাথে যেতে বলে।
১৯৯৪ এর বসন্তের এক সকালে যেদিন লায়লা পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সেদিন সে নিশ্চিত হয় যে রাশেদ নিশ্চয়ই পুরো ঘটনাটা জানে। যাইহোক সে মারিয়াম ও লায়লাকে কিছু না বলেই প্রতিদিনের মতো কাজে চলে যায়। লায়লা ও মারিয়াম জামা কাপড় প্যাক করে আজিজকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং একটি ট্যাক্সি নিয়ে বাস স্টেশনে পৌঁছায়। পথে লায়লা লক্ষ্য করে সাম্প্রতিক যুদ্ধ কিভাবে কাবুল কে প্রভাবিত করেছে।
স্টেশনে পৌঁছানোর পর লায়লা তার বাসের টিকিট কিনতে এবং তার আত্মীয় হিসেবে কাজ করতে সাহায্য করার জন্য একজন লোককে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করে। দু'বছর আগে মুজাহিদিনদের দখল নেয়ার পর থেকে কঠোর ইসলামিক আইন অনুসারে মহিলাদের কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আইনগুলি মহিলাদের নিজেদেরকে ঢেকে রাখতে বাধ্য করেছিল এবং ব্যভিচারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তাদের ভ্রমণের দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ অংশ শুরু হবে যখন তারা পাকিস্তান পৌছাবে। এর মধ্যে ২০ লক্ষ আফগান শরণার্থীর চাপে এই বছরের জানুয়ারির দিকে পাকিস্তান সরকার সীমান্ত এলাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তারাই যেতে পারবে যাদের কাছে ভিসা আছে। কিন্তু লায়লা শুনেছে অনেক শরণার্থী ঘুষের বিনিময়ে সীমান্ত পার করছে।
লায়লা অবশেষে একজন যুবককে দেখতে পায় যে একটু দূরে পার্কে বসেছিল। তার সাথে একজন মহিলা এবং একটি ছোট ছেলে ছিল যার বয়স হবে আজিজার মত। লায়লা তার কাছে সাহায্য চায়। সে তাদের টিকিট কিনতে সাহায্য করতে সম্মত হয় যখন লায়লা ব্যাখ্যা করে যে সে একজন বিধবা এবং তার সাথে তার মা এবং মেয়ে রয়েছে। লোকটি তাদের টিকিট কিনে দেয় এবং লায়লাকে বলে যে কোনো প্রহরী তাদের জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে যে সে তার চাচাতো ভাই।
লায়লা মারিয়মকে তাদের সাথে আসার জন্য ধন্যবাদ জানায় এবং সে স্বীকার করে যে তাকে ছাড়া সে এটা করতে পারতো না। লায়লা আশাবাদী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লায়লা ও মারিয়ম লোকটির আত্মীয়র সাথে বাসে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়ায়। লোকটি নিজে বাসে ঢোকার পর বাসের পাহারায় থাকা প্রহরীদের কাছে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। লায়লা, মারিয়ম এবং আজিজাকে সরে যেতে বলা হয়। লায়লা প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও তাদের তিনজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
লায়লাকে একজন অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি নির্ধারণ করেন যে পাকিস্তানে তার চাচার সাথে দেখা করার গল্পটি মিথ্যা। অফিসার এটি প্রকাশ করেন যে লায়লা যে পালানোর চেষ্টা করেছিল তা আফগান মহিলাদের মধ্যে স্বাভাবিক নয়। লায়লা অফিসার এর কাছে অনুরোধ করে যে তাদের এমন বাড়িতে যেন ফেরত না পাঠানো হয় যেখানে তাদেরকে অত্যাচার করা হয়। কিন্তু অফিসার ব্যক্তিগত পারিবারিক বিষয় হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেন।
পুলিশ অফিসাররা লায়লা, মরিয়ম এবং আজিজাকে রাশেদের বাড়িতে নামিয়ে দেয়। রাশেদ খুব ক্ষিপ্রতার সাথে লায়লাকে টানতে টানতে ওপরের ঘরে নিয়ে যায় এবং লায়লা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে মারিয়াম নির্দোষ। রাশেদ লায়লাকে ঘুষি মারে। ঘুষির তীব্রতা এত বেশি ছিল যে লায়লার মনে হয় সে কোনো ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। আজিজা তার কোল থেকে ছিটকে পরে। রাশেদ তাকে আজিজার সাথে টেনে বেডরুমে নিয়ে যায় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর রাশেদ মারিয়ামকে মারতে এগিয়ে যায় এবং তাকে নির্মমভাবে আঘাত করে। এরপর তাকে একটি যন্ত্রপাতির ঘরে আটকে রাখে। লায়লা জানালা দিয়ে দেখে রাশেদের ভ্রুতে ও মাথায় মারিয়ামের রক্তের চিন্হ রয়েছে।
ঘরের ভেতর একেবারে অন্ধকার। দরজার ফুটো কিংবা দেয়ালের ফাটল অথবা জানালার ছিদ্র দিয়ে যে আলোটুকু আসছিল রাশেদ কাঠের টুকরো দিয়ে সেটাকেও বন্ধ করে দেয়। লায়লা তার মেয়ে আজিজাকেও দেখতে পাচ্ছিল না।
রুমে তালা বন্ধ, আজিজা ক্ষিদেতে কাঁদতে থাকে। রাশেদ তাদের কোনো খাবার বা পানি দেয় না। আজিজা পানি শূন্য হয়ে পড়ে। লায়লা স্বপ্ন দেখে যে তারা তারিককে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু সে কথা শুনতে পায়নি। তিনদিন পর রাশেদ ঘরের দরজা খুলে দেয় এবং হুমকি দেয় যে যদি লায়লা আবারো এই ধরনের কাজের চেষ্টা করে তাহলে সে প্রথমে মারিয়ামকে তারপর আজিজাকে হত্যা করবে এবং দুজনের হত্যাকাণ্ড দেখার পর তাকে হত্যা করবে।
সেই ঘটনার আড়াই বছর পর ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালিবানদের আগমনের ঘটে। তালিবান হল তরুণ পাশতুনদের একটি দল, যাদের অনেকেই শরণার্থী হিসেবে বেড়ে উঠেছে। তারা মোল্লা ওমরকে অনুসরণ করে।
আড়াই বছর আগে যখন মারিয়ম এবং লায়লা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হল তারপর থেকে রাশেদ তাদের দুজনকে কোনো মানুষের কাতারেই ফেলে না। প্রতিটি পদক্ষেপে সে তার ঘৃণা প্রকাশ করতে দেরি করে না।
রাশেদ বলতো তালিবানদের একটা বিষয় খুব ভালো, তারা একতাবদ্ধ। তাদের আগমনে রাশেদ তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য রাস্তায় নেমে গেল। প্রতিবেশীরা সবাই রাস্তায় নেমে আসলো। মারিয়ম দেখল কেউ একজন অনেক বড় একটা কাপড়ের মধ্যে লিখে রেখেছে জিন্দাবাদ তালিবান। তালিবান দীর্ঘজীবী হোক। রাস্তায় বিভিন্ন জানালায় দরজায় দেওয়ালে সে রকম আরও অনেক লেখা দেখা গেল।
তালিবানের প্রবেশদ্বারের প্রধান দর্শন ছিল এমন একটি দৃশ্য যেখানে একজন তালিব একটি মেগা ফোন নিয়ে ট্রাফিক পোস্টে ঝুলন্ত দুইজন মৃত সোভিয়েতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঘোষণা করে যে এই ব্যক্তিরা কাফের ছিল এবং তাদের শাস্তি প্রতিফলিত করে যে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে অপরাধ করবে তাদের কি হবে।
পরদিন কাবুলের জনগণ একটি বার্তা পায় যাতে তালিবান কর্তৃক প্রণীত আইনের তালিকা ছিল। তাদের বিশেষ একটা ঘোষণা যেটাকে শরিয়া মেসেজ বলে তারা প্রচার করতে লাগল যেটা মসজিদ থেকে প্রচার করা শুরু হল। প্রত্যেক নাগরিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে প্রতিদিন। নামাজের সময় যদি কাউকে অন্য কাজে পাওয়া যায় তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। সমস্ত পুরুষ তাদের দাঁড়ি রাখবে এবং দাঁড়ি হবে এক মুষ্টি লম্বা। সমস্ত কিশোর বালকেরা ইসলামিক পোশাক পরিধান করবে, কলারওয়ালা শার্ট অবশ্যই বোতাম লাগানো হতে হবে। সব ধরনের গান বন্ধ, নাচ বন্ধ, বই লেখা, সিনেমা দেখা, ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। তাস খেলা, দাবা খেলা, জুয়া খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো নিষিদ্ধ। যদি কেউ চুরি করে তাহলে তার হাত কব্জি অব্দি কেটে নেওয়া হবে। তারপরেও যদি কেউ চুরি করে তাহলে তার পা কেটে নেওয়া হবে। যদি কেউ অমুসলিম হয় তাহলে তাকে এমন কোনো জায়গায় বসে প্রার্থনা করতে হবে যেখান থেকে কোনো মুসলিম তাকে দেখতে পাবে না। যদি কোনো অমুসলিম কোনো মুসলিমকে তাদের ধর্মে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। মহিলারা সবসময় ঘরের ভেতরে অবস্থান করবে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘরের বাইরে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা যাবেনা। যদি রাস্তায় বের হয় তাহলে অবশ্যই একজন পুরুষ আত্মীয়কে সাথে নিয়ে বের হতে হবে। যদি একা বের হয় এবং ধরা পড়ে তাহলে শাস্তি দিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হবে। কোনো অবস্থাতেই নিজেদের চেহারা দেখানো যাবে না। যখনই বাইরে বের হবে অবশ্যই বোরখা দিয়ে সারা দেহ ঢেকে রাখতে হবে না হলে প্রহার করা হবে। যেকোনো ধরনের প্রসাধন নিষিদ্ধ করা হয়, অলংকার নিষিদ্ধ করা হয় এবং মনোমুগ্ধকর চমৎকার আকর্ষণীয় কোনো পোশাক পরা যাবে না। পুরুষদের চোখের দিকে তাকাতে পারবেনা, জনসাধারণের মাঝখানে হাসতে পারবে না। নিজেদের পায়ের নখ রং করতে পারবে না। মহিলারা কোনো রকমের চাকরি বা কাজ করতে পারবেনা। যদি কোনো মহিলা ব্যাভিচারের কাজে ধরা পড়ে তাহলে তাকে পাথর ছুঁড়ে মারা হবে।
লায়লা তালিবানদের জোরপূর্বক গৃহবন্দী করার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। রাশেদ তাকে জানায় যে আফগানিস্তানের বাকি অংশ ইতিমধ্যে এগুলি অনুসরণ করছে। তালিবানরা যখন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল লায়লা এটা ভেবে খুশি হয় যে তার বাবা আর বেঁচে নেই। তাকে এইসব দেখতে হচ্ছে না। নয়তো এই দৃশ্য তাকে পঙ্গু করে ফেলত। বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাদুঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, নিদর্শন এবং বই ধ্বংস করা হয়েছে। সিনেমা হলে ভাঙচুর করা হয় এবং বিনোদনকারীদের কবরে সন্ত্রাস করা হয়। মারিয়াম তার বাবা এবং তার সিনেমা হলের কথা চিন্তা করে।
এক রাতে রাশেদ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তালিবানদের নিয়ে লায়লার সাথে কথা বলছিল। সে লায়লাকে বলে আজিজার চোখের রং অদ্ভুত যেটা না রাশেদের মতো না লায়লার মতো এবং যদি তার সন্দেহ সত্য হয় তাহলে সে আজিজাকে চলে যেতে বাধ্য করবে। সে তালিবানদের কাছে যাবে এবং তাদের জানাবে লায়লার চরিত্রের দোষ আছে।। লায়লা রাশেদকে ঘৃণ্য বলে।
লায়লা শীঘ্রই বুঝতে পারে যে সে আবার গর্ভবতী। সে সাইকেলের স্পোক ব্যবহার করে তার অনাগত সন্তানকে গর্ভপাত করার প্রস্তুতি নেয়। সে মনে করে না তারিকের মত রাশেদের সন্তানকে আদর করার ক্ষমতা তার আছে। তবে বাথরুমের মেঝেতে বসে সে গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে যেতে পারেনি। সে বুঝতে পারে যে রাশেদের সঙ্গে তার যুদ্ধের সাথে শিশুটি জড়িত নয় এবং শিশুটিকে হত্যা করা হবে একটি নিরাপরাধকে হত্যা করা।
যেদিন লায়লা তার দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের জন্য যায় সেদিন তালিবানদের পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা আলাদা হাসপাতাল ব্যবস্থার স্থানান্তরের কারণে সে এবং তার পরিবার চারপাশে ঘুরতে বাধ্য হয়। লায়লাকে রাবেয়া বালখি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তারা জানতে পারে বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ,এমনকি বিদ্যুৎও নেই।
যখন তারা হাসপাতালে পৌঁছায় ওয়েটিং রুম অনেক মহিলা এবং তাদের পরিবারের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। মারিয়ম লায়লাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে যে তাকে একজন ডাক্তার দেখবে এবং মারিয়ম ওয়েটিং রুমের ভিড়ের মধ্যে লড়াই করে। এই মুহূর্তে মারিয়ম একজন মায়ের ত্যাগের কথা স্বীকার করে এবং সে নানার প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকথাকে প্রতিফলিত করে। মারিয়ম জানতে পারে যে হাসপাতালে মাত্র দুজন ডাক্তার কাজ করছেন এবং একজন নার্স তাকে লায়লকে সামনে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন।
অবশেষে লায়লাকে একজন ডাক্তার দেখে। ডাক্তার লায়লার পেট এবং বাচ্চার অবস্থান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর বলেন যে তাকে সিজারিয়ান করাতে হবে। বাচ্চাটি খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে এবং সে নিজে নিজে বের হয়ে আসতে পারবেনা। ডাক্তার মারিয়মকে ফিসফিস করে বলেন যে এই পদ্ধতির জন্য অজ্ঞান করার ওষুধ তাদের হাসপাতালে উপলব্ধ নেই। ডাক্তার খুব জোর দিয়ে বলেন যে, হাসপাতালে সাধারণভাবে খুব কম চিকিৎসার সরঞ্জাম রয়েছে। মারিয়ম অজ্ঞান হওয়ার ওষুধের নাম নেওয়ার চেষ্টা করে যাতে সে লায়লার জন্য এটি নিয়ে আসতে পারে কিন্তু লায়লা ডাক্তারকে জানায় তাকে কেটে যেন তার বাচ্চাকে বের করে আনা হয়। ডাক্তার প্রক্রিয়াটি নিয়ে এগিয়ে যান এবং মারিয়ম অবাক হয়ে যায় যে লায়লা কতক্ষণ চিৎকার না করে যেতে সক্ষম হয়।
১৯৯৮ এর শুরু থেকে রুক্ষতা এবং শুষ্কতা শুরু হয়েছিল যেটা পরবর্তী বছর পর্যন্ত চলতে থাকলো। গত বছর শীতে প্রচন্ড বরফ পড়েছে এবং বসন্তে আর কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। সারা দেশেই কৃষকরা তাদের জমি জমা ছেড়ে আসবাবপত্র বিক্রি করে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পানির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু মারিয়ম আর লায়লা কাবুলেই থেকে গেল। কূপের সরু লাইনটা মাটির অনেক নীচে ছিল। কাবুল নদী বসন্তের বন্যা ছাড়া শুকনোই থাকে। তাই তারা কোদাল নিয়ে গর্ত খননের কাজ শুরু করে।
মারিয়মের বয়স এখন ৪০। তার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। মুখে বলিরেখা দেখা যাচ্ছে। দাগ পড়ে গেছে, চুল কিছু পেকে গেছে। মারিয়ামের সামনের দুটো দাঁত নেই। একটা এমনিতেই পড়ে গিয়েছিল আর অন্যটা লায়লার দ্বিতীয় ছেলে সন্তান জালমাইকে কোল থেকে দুর্ঘটনাবশত ফেলে দেওয়ার কারণে রাশেদ তাকে ঘুষি মেরে দাঁতটা ফেলে দিয়েছিল।
জালমাই এর বয়স এখন দুই বছর। তার মাথার চুল গুলো কোকড়ানো। সে তার বাবার মতই হয়েছে। মাথার চুলগুলো, চুলের সিতি সবকিছুই রাশেদের মতো। লায়লা যখন তার সাথে একা একা থাকে তখন জালমাই খুব হাসি খুশি থাকে। খেলাধুলা করে,লায়লার কাঁধে উঠতে সে পছন্দ করে। আজিজা ও লায়লার সাথে সে উঠোনে লুকোচুরি খেলতে খুব ভালোবাসে।
জালমাই তার বাবাকে অনেক পছন্দ করে। সে যাই করে রাশেদ বলে এটা হল বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ।
রাশেদ আজিজার কোনো পুরনো খেলনা ব্যবহার না করে জালমাই এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে শুরু করে। রাশেদ পরিবারকে জানায় যে ব্যবসা ভালো না চলা সত্ত্বেও সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে জালমাই এর জিনিসপত্রের জন্য টাকা ধার করতে সক্ষম। সে জোর দিয়ে বলে যে তাদের আর্থিক অবস্থা শীঘ্রই ঘুরে দাঁড়াবে।
অধিকাংশ সময় লায়লা তার সন্তানকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। কারণ রাশেদ জালমাইকে নিয়ে দোকানে চলে যায়। সেখানে সে ভিড়ের মধ্যে তার দোকানে ছেলেটাকে ছেড়ে দেয় আর দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। জালমাই যদি কোনো দুষ্টুমি করে তাহলে রাশেদ তাকে হাসতে হাসতে মৃদু ধমক দেয়। সন্ধ্যার সময় জালমাই তার বাবার কাঁধে চেপে দোকান থেকে ফিরে আসে। তখন তাদের শরীর থেকে চামড়ার গন্ধ আসে। জালমাই তার বাবার সাথে থাকতে খুব পছন্দ করে। রাতে খাওয়ার সময় সে তার বাবার সাথে বসে।
জালমাই এর জন্য রাশেদের খরচের চূড়ান্ত কেনাকাটা হল একটি টেলিভিশন ও একটি ভিসিআর। তালিবানদের মতে এগুলি বেআইনি কিন্তু রাশেদ চোরা বাজার থেকে এগুলি কিনে নিয়ে আসে। টিভ টি জালমাই এর একা বলে রাশেদ ঘোষণা করে।
আজিজা অল্প বয়স হওয়া সত্বেও একজন অত্যন্ত পরিণত ও চিন্তাশীল শিশু হয়ে ওঠে। জালমাই এর যত্ন নিতে সে খুব বড় দায়িত্ব পালন করে। লায়লা তার মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে বেশ অবাক হয়। আজিজার কথার ভঙ্গি, চালচরণ সবকিছুতেই বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
খড়া ও দুর্ভিক্ষের কারণে অনেক রাতই তারা সাদা ভাত আর চা দিয়ে রাতের খাবার শেষ করে। রাশেদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, আজিজাকে দিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করাবে। এতে সে যে সমস্ত টাকা ধার নিয়েছে তা শোধ করা যাবে। লায়লা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে এবং জবাবে রাশেদ তাকে চড় মারে। লায়লা পাল্টা ঘুষি মারে রাশেদকে। রাশেদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে বন্দুক নিয়ে এবং বন্দুকের ব্যারেলটি লায়লার মুখের ভেতর চেপে ধরে কিন্তু গুলি করে না।
তালিবানরা প্রায় সময়ই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালায়। তল্লাশি করে কারো বাড়িতে নিষিদ্ধ কিছু আছে কিনা তা খুঁজে দেখে। মারিয়াম ও লায়লা টিভিটিকে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে খুব আস্তে আস্তে মাটির গর্তে নামিয়ে রাখে। যখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে, যখন তালিবানদের তল্লাশি শেষ হবে তখন আবার টিভিটাকে উপরে ওঠানো হবে।
২০০০ সালের গ্রীষ্মকাল। তিন বছর ধরে অনাবৃষ্টির ফলে এই বছরটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। গ্রীষ্মের শেষে এক সুতো ব্যবসায়ী তার দোকানে সিগারেট না নিভিয়ে ঘুমিয়ে যায়। দোকানে আগুন লেগে যায়। সে বেঁচে যায় কিন্তু তার দোকানটি পুড়ে যায় এবং আশেপাশে আরো অনেকগুলো কাপড়ের দোকান, আসবাবপত্রের দোকান পুড়ে যায়। রাশেদের জুতোর দোকানটিও পুড়ে যায়।
তারা সবকিছু বিক্রি করা দেয়। দোকান পুড়ে যাওয়ার পর রাশেদ অধিকাংশ সময় ঘরে বসে কাটাত। আজিজাকে থাপ্পড় মারতো, মারিয়ামকে লাঠি মারতো, জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছুড়ে মারতো, লায়লার প্রতিটি কাজে দোষ ধরত। রাশেদ একটা কাবাব হাউসে কাজ নিয়েছিল কিন্তু সেখান থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। কারণ কাস্টমাররা দাবি করেছিল রাশেদ খুব জোরে জোরে কাবাব রুটির থালা টেবিলের ওপর রাখে। এছাড়াও খুব রুঢ়ভাবে কাস্টমারের সাথে কথা বলে। এই নিয়ে লায়লা রাশিদকে উত্যক্ত করে। রাশেদ লায়লার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে মারতে থাকে। আজিজা কাঁপতে কাঁপতে রাশেদের শার্ট ধরে টানতে থাকে, জালমাই চিৎকার করে তার মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। রাশেদ লায়লাকে মাটিতে ফেলে লাথাতে শুরু করে। মারিয়ম লায়লার উপর শুয়ে পড়লে, রাশেদ মারিয়ামকেও মারতে থাকে। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে রাশেদ ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ঘরের ভেতর ক্ষুধার বিষয়টা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। ঘরে ইতিপূর্বে শুধু সাদা ভাতের যে আয়োজন ছিল সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। কখনো কখনো রাশেদ শুকনো রুটি নিয়ে আসতো।সেটা দিয়ে কাজ চলতো। আবার কখন কখনো সে ফলের দোকান থেকে চুপিসারে ব্যাগ ভর্তি করে আপেল নিয়ে আসতো। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যাওয়াটার প্রায় সত্যি হয়ে উঠছিল। মারিয়াম শোনে তাদের এক প্রতিবেশী রুটির সাথে ইদুর মারার বিষ মিশিয়ে তার সাতটা সন্তানকে খাইয়ে দিয়েছে।
মারিয়ম তার পরিবারকে ক্ষুধার হাত থেকে বের করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে। এক প্রচন্ড গরমের দিনে মারিয়াম বোরখা পরে রাশেদের সাথে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাওয়ার জন্য বের হয়। হোটেলে তারা বন্দুক সজ্জিত অনেক পুরুষ কে দেখতে পায়। হোটেলে ঢোকার মুখেই রাশেদ একজন দারোয়ানকে সালাম জানিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে। তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ত্ব সুলভ কথা হয় কিছুক্ষণ। মারিয়াম ভাবে তাদের মধ্যে হয়তো পারিবারিক কোনো বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল। রাশেদ ও মারিয়ম জলিলকে ফোন করার জন্য একটি কর্ডলেস ফোন ব্যবহার করে। মারিয়ম অবাক হয়ে ভাবছিল প্রায় ১৩ বছর আগে ১৯৮৭ সালে বাবার সাথে তার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। মারিয়ম হিরাতে মেয়রের অফিসে ফোন করে এবং জলিলের খবর জানতে চায়। অফিসের লোকটি তাকে জানায় ১৯৮৭ সালে জলিল খান মারা গেছে।
২০০১ সালে আহমেদ শাহ মাসুদ তালিবানের বিরুদ্ধে একটি বিরোধী জোটের সমর্থন পেতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাথে কথা বলতে যান। সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে ইউরোপকে সতর্ক করেন এবং তাদের সমর্থন চান। লায়লা জানতে পারে তালিবানরা ২০০০ বছর পুরনো বুদ্ধমূর্তিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে এবং এই ঘটনা গোটা বিশ্বে নজর পড়েছিল।
রাশেদ মারিয়াম ও লায়লা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আজিজাকে এতিমখানায় রেখে আসবে। সেখানে সে অন্তত খাবার খেতে পাবে। কারতেহ শাহ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় জালমাই রাশেদের হাত ধরে হাঁটছিল। আজিজ মারিয়ামের হাত ধরে খুব দ্রুত হাঁটছিল। আজিজাকে বেশ কঠোর মনে হচ্ছিল। লায়লা আজিজাকে সত্য কথাটা বলার মত শক্তি বা সাহস কোনটাই পায়না। সে শুধু বলেছে যে আজিজাকে একটা বিশেষ স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। যেখানে বাচ্চারা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমায় কিন্তু ক্লাস শেষ করে বাড়িতে ফিরে আসে না।
লায়লা আজিজার দিকে তাকায়। তার কষ্টে বুক ভেঙে আসে। সে এটা ভেবে কষ্ট পায় যে আজ দুপুরের পর থেকে আজিজাকে নিয়ে সে আর শুতে পারবে না। আজিজার কোমল হাতটা তার বুকের উপর রাখতে পারবে না। তার গলায় আজিজার গরম শ্বাস টের পাবে না। আজিজা যখন চলে যাচ্ছিল তখন জালমাই চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে।
লায়লা, মারিয়াম ও আজিজা তিনজনে একসাথে বড় বিল্ডিংটার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে আজিজা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এতিমখানার পরিচালক বেশ সরু বুক আর কুঞ্চিত লম্বা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ। তার নাম জামান। তারা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটু দূরে অনেকগুলো বাচ্চাকে একসঙ্গে খেলতে দেখে। লায়লা আশেপাশে সাবান ও প্রস্রাবের গন্ধ টের পায়। সে খুব সতর্কতার সাথে আজিজাকে দেখে, আজিজা ফুপিয়ে কাঁদছিল। জামান বেশ কোমল ভাবে এতিমদের সাথে ব্যবহার করছিল। যখন লায়লা ও মারিয়াম আজিজাকে ছেড়ে চলে যায় তারা অনেক কষ্টে নিজেদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে , বোরখার আড়ালে লায়লা নিজের কান্না লুকিয়ে রাখে কিন্তু আজিজা চিৎকার করে ও আতঙ্কিত হয়।
এতিমখানায় আজিজার থাকার শুরু শুরুতে রাশেদ জালমাই,মারিয়াম ও লায়লাকে নিয়ে ১৫ মিনিটের জন্য আজিজকে দেখতে আসতো। রাশেদ অবশ্য নিজের ইচ্ছেতে দেখতে যেত না। কয়েকদিন পর থেকেই সে নানা ভাবে এতিমখানায় না যাওয়ার অজুহাত দেখাতে শুরু করে। প্রতিবারই এতিমখানায় আসার সময় রাশেদ নানা রকম অজুহাত তৈরি করে। সে বলে তার পায়ে প্রচন্ড ব্যথা, আসতে পারবে না, হাঁটতে পারবে না। রাস্তার মধ্যে এসে বলে যে আজকে সে মোটেও হাঁটতে পারবে না। তারপর সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা দিত। কোনোদিন বলত তার বুকে ব্যথা। লায়লা অসহায়ের মতো রাগে কাঁপতে থাকত। একদিন রাশেদ লায়লাকে জানায় সে আর তাকে নিয়ে এতিমখানায় যেতে পারবে না। প্রতিবাদে লায়লা তাকে জানায় সে নিজেই যাবে। ফলে হঠাৎ করেই লায়লার জীবনটা তার মেয়েকে দেখার জন্য নতুন এক যুদ্ধে নেমে পড়ে। অধিকাংশ সময়ই সে এতিমখানায় যেতে পারত না। রাস্তা অতিক্রম করার সাথে সাথে তালিবানদের মুখোমুখি পরে যেত। ভাগ্য ভালো থাকলে কখনো কখনো হয়তো একটা লাথি কিংবা গলা ধাক্কা দিত। তবে প্রায় সময়ই গাছের কাঠ দিয়ে আঘাত কিংবা চড় থাপ্পড় তাকে সইতে হত। একদিন এক তরুণ তালিব তাকে রেডিওর এন্টেনা দিয়ে বেধড়ক মারে, গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে রাখে। তখন হয়তো সে বাড়ি ফিরে আসে এবং আবার অন্য রাস্তা দিয়ে এতিমখানার দিকে হাঁটা দেয়। লায়লা তীব্র গরম সত্ত্বেও বোরখার নিচে অনেকগুলো জামা একত্র করে পড়ে যাতে মার দিলেও সে বেশি আঘাত প্রাপ্ত না হয়। এত কষ্টের পরও তার একমাত্র প্রাপ্তি ছিল আজিজার সাথে দেখা হওয়া। আজিজার সাথে দেখা হওয়ার পর তারা এতিমখানার উঠোনে বসে কথা বলত। আজিজা সে সপ্তাহে কি শিখল সেটা নিয়ে আলোচনা করত। এতিমখানায় থাকাকালীন আজিজার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে, সে আরো অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠ।
আজিজাকে যখন তারা দেখতে আসে তখন সে এক মুহূর্ত চুপ থাকেনা। অনবরত কথা বলে। এতিমখানার পরিচালক তাকে যা শেখায় সেগুলো নিয়ে সে আলোচনা করে, তার গলার স্বর তখন থাকে বেশ উঁচু।লায়লা ও মারিয়াম আজিজাকে নিয়ে এতিমখানা থেকে বের হয়ে আসে রাশেদের সাথে দেখা করার জন্য। রাশেদ তাদের জন্য বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল।আজিজা রাশেদের সাথে ভাব বিনিময় করে। রাশেদ তাদেরকে তাড়াতাড়ি করতে বলে। কারণ সে দুই ঘণ্টার জন্য কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। কিছুদিন হল রাশেদ ইন্টারকন্টিনেন্টাল একটি হোটেলে দারোয়ানের কাজ জোগাড় করেছে। সে লায়লাকে কথা দিয়েছে যে কিছু টাকা জমিয়ে সে আজিজাকে আবার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসবে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর তারা আবার আজিজাকে এতিমখানায় দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় এবং রাশেদ তার কাজে চলে যায়। বাড়ি ফিরে তারা দেখে বাড়ির মূল দরজার সামনে একজন লোক ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। লায়লা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখছিল। লোকটি ছিল তারিক। তারিক সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় লায়লার বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে ছিল।
বাকি অংশ পরের পর্ব…
4:00 AM, September 01, 2022