"আমাকে একটি গাছ কাটার জন্য ৬ ঘন্টা দাও তার থেকে আমি প্রথম চার ঘণ্টা শুধুমাত্র কুঠার ধার করার জন্য খরচ করব" এমন বক্তব্য ছিল আমেরিকা তথা বিশ্বের সর্বসেরা রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন আব্রাহাম লিঙ্কনে'র যিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আজ আমরা বিখ্যাত লেখক ডেল কার্ণেগীর বই আব্রাহাম লিঙ্কন এর জীবনী "লিঙ্কন দ্য আননোন" এর থেকে জানবো কিভাবে একজন গরিব নৌকাচালক কাঠের কুঠুরি থেকে যাত্রা শুরু করে The White House পর্যন্ত পৌঁছান।

আব্রাহাম লিঙ্কনের জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে পাহাড় ঘেরা কেন্টুকি'র কাছাকাছি হয়েছিল । তাঁর বাবার নাম থমাস লিঙ্কন যিনি নিতান্তই ধার্মিক গৃহকর্তা ছিলেন।

থমাসের অলসতার কারণে লিঙ্কন পরিবারকে জঙ্গলে একটি কাঠের কুঠুরিতে থাকতে হতো

শিশু লিঙ্কনের ঘুমানোর জন্য ভাগ্যে জুটেছিল শুকনো কিছু ঘাস এবং শীত কালে পুরো লিঙ্কন পরিবারকে ভালুকের চামড়া গায়ে দিয়ে দিন কাটাতে হতো। এরইমধ্যে লিঙ্কন পরিবার জমি জাতীয় বিবাদে জড়িয়ে যায় এবং যার ফলে তাদের সেই জায়গা ছাড়তে হয়। শিশু লিঙ্কন তখন মাত্র ৭ বছরের ছিলেন এবং সেই সময়ে তাদের নতুন ঠিকানা ছিল সেখান থেকে প্রায় আড়াইশো মাইল দূর ইন্ডিয়ানা প্রদেশ। এখানে আসার পরেও লিঙ্কন পরিবারের ভাগ্য একটুও বদলায়নি, তারা ঠিক আগের মতোই যাই হোক করে দিন কাটাতে শুরু করে, ইতিমধ্যে সেই এলাকাতে মহামারী ছড়িয়ে যায় যার ফলে হাজার হাজার লোকের প্রাণ হানি হতে শুরু হয় এবং এই মহামারীর কারণে একদিন ন্যান্সি লিঙ্কন যথেষ্ট অসুস্থ হয়ে যান কিন্তু দারিদ্রতা এবং ডাক্তার না থাকার কারণে কোনোরকম চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ৫ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়, সেসময় আব্রাহাম লিঙ্কনের বয়স মাত্র নয় বছর ছিল।এইসময় পুরো পরিবারের দায়িত্ব সারা লিঙ্কন অর্থাৎ আব্রাহামের বড়বোনের ওপরে চলে আসে। এভাবে স্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যুর ফলে থমাস প্রায় পাগল হয়ে যান, প্রায় একবছর এভাবেই চলে এবং একবছর পরে এক প্রকার বাধ্য হয়ে আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেন, থমাস লিঙ্কনের দ্বিতীয়স্ত্রী সারাবুশ লিঙ্কন একজন বিধবা ছিলেন, যাঁর আরো তিন জন সন্তান আগে থেকেই ছিল।

পরিবারে আব্রাহামের সৎমা আসার পরে তাদের জীবনটা যেন বদলে যায়, সারাবুশ সব সময় চাইতেন যে আব্রাহাম লেখাপড়া করুক এবং এই জন্যই তিনি আব্রাহামকে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করান, সারাবুশ , লিঙ্কনকে নিজের মায়ের থেকেও বেশি স্নেহ করতেন,এবং শিশু লিঙ্কনও তাঁকে নিজ মায়ের মতোই সম্মান করতেন। সারা বলেন " লিঙ্কন এর মতো সৎ এবং পরিশ্রমী শিশু আমি দেখিনি, সে আমাকে কোনোদিন মিথ্যে কথা বলেনি। তেমনই লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বলেছিলেন " আজ আমি যা কিছু হয়েছি তার জন্য শ্রেয় শুধু আমার মা সারারই"

সারা বুশ লিঙ্কনকে স্কুলে ভর্তি তো করিয়ে দেন, কিন্তু সেখানে তাঁর ঠিক মতো পড়াশুনা হয়নি, তার বেশ কয়েকটি কারন ছিল, যেমন দারিদ্রতার জন্য লিঙ্কনকে প্রচন্ড কাজ করতে হতো, স্কুল কয়েক মাইল দূরে ছিল,আর সবচেয়ে বড় কারন স্কুলের পরিবেশ ঠিক ছিল না।

কিন্তু এসবের পরেও লিঙ্কন অনেক কিছু শিখেছেন সেখানে। তাঁর কবিতার নেশাটিও এই স্কুল থেকেই পাওয়া। লিংকন বহুকষ্টে শুধু পড়তে শিখেছিলেন মাত্র, লিখতে তিনি তার অনেক পরে শিখেছেন। যখন থেকে লিঙ্কন পড়তে শিখেছেন তখন থেকেই তাঁর বই এর নেশা ধরে যায়, রবিনশন ত্রুশো, পিলগ্রিমস, পোগ্রেস এর মতো লেখকদের বই পড়তেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল বাইবেল এবং আরব্য রজনীখ্যাত সিন্দবাদ নাবিক এর কাহিনী। এছাড়াও আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন এর জীবনীও তাঁর উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।

লিঙ্কন এর দূর সম্পর্কের এক ভাই বলেন " আমি জীবনে আব্রাহামকে বই ছাড়া দেখিনি, এমনকি সে যখন খামার বাড়িতে চাষের কাজ করতো তখনও তার কাছে অন্তত একটা বই থাকতো, যখনি সুযোগ পেতো তখনই সে কিছুক্ষন বইএর পাতায় ডুব দিয়ে দিতো। "

লিঙ্কন তাঁর বাবাকে চাষের কাজে প্রায়ই সাহায্য করতেন, এবং সবশেষে একটি বই পড়ার জন্য মাইল এর পর মাইল হেঁটে যেতেন। তিনি প্রায় বলতেন " বই এর জন্য আমি পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারি । "

এছাড়া তিনি দিনের পর দিন গল্প বলে পারদর্শী হচ্ছিলেন, এর ফলে প্রতিবেশীরা তাঁকে কাজের জন্য ডাকতে শুরু করেন, যাতে তিনি কাজের ফাঁকে তাদের গল্প বা কবিতা বলে আনন্দ দিতে পারেন, এরই মাঝে লিঙ্কন আইন বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, যার ফলে তিনি আইনজীবী হয়ে যান, তিনি পাগলের মতো আদালতে গিয়ে মামলার শুনানি শুনতে, এবং পরে মাঝে দিতেও পারতেন, বিশেষ করে তিনি ইন্ডিয়ানার আইন পড়তে ১২ মাইল হেটে যেতেন, এই সময় দুটি বই তার উপর খুব গভীর প্রভাব বিস্তার করে

১ "ইন্ডিয়ানার সংশোধিত আইন" (REVISED LAWS OF INDIANA ) এবং

২ "কলম্বিয়ান ক্লাস বুক" (THE COLOMBIAN CLASS BOOK)

১৮২৮ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে লিঙ্কন এক প্রতিবেশীর নৌকা বানানোর কাজ পেয়ে যান, এবং সেটা তিনি দক্ষতার সাথে পূরণ করেন ।

১৮৩০ সালে থমাস যখন ইন্ডিয়ানা ছেড়ে ইলিনয় চলে আসনে তখনই শুরু হয় আরেক নতুন অধ্যায়।

ইলিনয় এ লিঙ্কন নৌকা চালানোর কাজ করতেন, একদিন নৌকা চালানোর সময় ঘটে এক দুর্ঘটনা। লিংকন জলে পরে যান, বহুকষ্টে তিনি শীতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসেন, মেজর ওয়ার্নিক এর তীরবর্তী বাড়িতে উঠে আসেন, যেখানে লিঙ্কন প্রায় এক মাস অসুস্থ অবস্থায় থাকেন।

সেখানে থাকাকালীন সবাইকে গল্প বলতেন কবিতা শোনাতেন। তার সেখানে অনেক মুগ্ধ শ্রোতা ছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল মেজর ওয়ার্নিক এর কিশোরী কন্যা। লিঙ্কন তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং একদিন মেজর ওয়ারনিককে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেন। কিন্তু মেজর বলেন তিনি তাঁর মেয়ের বিবাহ এমন কারো সাথে করবেন না যার নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নেই এবং যে খুব বেশি গরিব। একথায় লিংকনের যথেষ্ট কষ্ট হয়, এবং তিনি মেজরের বাড়ি ছেড়ে ফিরে আসেন।

তিনি এখানেই অর্থাৎ ইলিনয় এ একদিন দাস ব্যবসার নগ্ন রূপ দেখেন যে, মানুষ লোভের ফলে কতটা ত্রুর হতে পারে, এতদিন এসব তিনি শুধু বইয়েই পড়েছিলেন মাত্র, কিন্তু আজ সচক্ষে দেখে অনুভব করেন। তাঁর এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন "যদি কোনোদিন সুযোগ পাই তাহলে এই বর্বর ব্যবস্থার উপরে আমি চরম আঘাত হানবো"

কিন্তু তিনি আরো বেশ কয়েক বছর পরে জনসমক্ষে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেন।

১৮৩১ সালে ডেনিস হ্যাংকস এবং লিঙ্কন কাজের খোঁজে স্যাঙ্গামন নদী পার করে ইলিনয় থেকে নিউ সালেম চলে আসেন, সেখানে তারা ১২ ডলার মাসিক বেতনে কাজ করতে শুরু করেন । নিউ সালেমে লিঙ্কনের কিছু নতুন বন্ধু হয় এবং সেই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন স্কুলের প্রধানশিক্ষক গ্রাহাম মেন্টর এবং দ্বিতীয় ছিলেন জ্যাক ক্যালসো। এরা দুজন লিঙ্কনের যোগ্যতাকে ভালোকরেই জানতেন, তাই ১৮৩২ সালে তাঁরা একটি আলোচনা সভা আয়োজন করেন, যে সভাতে বক্তা হিসেবে আব্রাহাম লিংকন সেরা ছিলেন। এই সভাতেই শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আব্রাহাম লিংকন আগামী স্টেট লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি (SLA) ভোটে দাঁড়াবেন দিনটি ছিল ৯ মার্চ ১৮৩২, কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছুই লেখা ছিল লিনকন ভোটে দাঁড়ালে ভোটে জিততে পারেননি এটি ছিল তার প্রথম হার তখন তার বয়স মাত্র ২৩। অবশ্য এর দু'বছর পরে তিনি আবার ভোটে দাঁড়ানা এবং জিতে যান ১৮৩৬, ১৮৩৮ এবং ১৮৪০ পুনরায় জয়লাভ করেন।

এখানে তিনি বেরী নামক একজনের সাথে অংশীদার হিসেবে দোকান শুরু করেন, যেটি কোনোদিনই সঠিকভাবে চলেনি। কারণ বেরী ছিলেন একজন প্রচন্ড সূরাসক্ত লোক, আর লিঙ্কন বই আসক্ত , বেরী সারাদিন বোতল বোতল সূরা পান করতো, আর লিঙ্কন সারাদিন বই এই পাতায় ডুব দিয়ে বেড়াতেন। ফলে ভবিতব্য সেটাই হলো যা হওয়ার ছিল, বেরী মারা গেলেন আর লিঙ্কন ১২০০ ডলার দেনায় পরে গেলেন। তিনি চাইলেই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বাঁচতে পারতেন, কিন্তু সততার প্রতীক লিঙ্কন সেটা না করে সব দেনা নিজেই শোধ করেছেন। নিউ সালেমে একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন যার নাম ছিল জেমস রুটলেজ।

এই জেমস রুটলেজে একজন ১৯ বছর বয়সী কিশোরী কন্যা ছিল, যার নাম অ্যান্ রুটলেজ। যাকে লিঙ্কন মনে মনে পছন্দ করতেন। এমন সময় অ্যান্ এর বিবাহ ভেঙে যায়, তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অ্যান্ কে পোস্টমাস্টার লিঙ্কন মানসিক সহায়তা দেন এবং সময়ের সাথে তাদের সেই সঙ্গ বন্ধুত্বে, এবং সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে এই কথাটির পুরো নিউ সালেমে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু লিংকনের ভাগ্য এত তাড়াতাড়ি উদয় হতে চাইছিল না, যখন লিঙ্কন তার কিশোরী প্রেমিকার সঙ্গে সুমধুর কল্পনায় ব্যস্ত তখন আড়াল থেকে ভাগ্য অন্য কিছুই লিখতে চাইছিল । হঠাৎ করে টাইফয়েড মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়ে, একসময় মিস রুটলেজও মহামারীর কবলে পড়েন, আর এবারেও লিঙ্কন নিজ মায়ের মতোই আরেক প্রিয়জনকে নিজের চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেন। এবারে আর নিজেকে সামলানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান এবং ধীরে ধীরে হতাশা গ্রস্ত হয়ে যান। একসময় পরিচিতদের বলে বেড়াতেন যে তিনি আত্মহত্যার পথই শেষ পর্যন্ত বেঁচে নেবেন। আর ঠিক সময়ই তার পশে পান বেশ কিছু বন্ধুদের, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পশে পান বৌলিং গ্রীন এবং তাঁর স্ত্রী ন্যান্সি গ্রীনকে। একপ্রকার জোর করেই গ্রীন দম্পতি লিঙ্কনকে নিজের সাথে নিয়ে যান, মাসখানেক তিনি সেখানে থাকেন, কর্মে তাঁর অবস্থার উন্নতি হয়।

১৮৩৭ সালের দিকে তিনি আইনজীবী হওয়ার জন্য নিউ সালেম ছেড়ে স্প্রিংফিল্ড চলে আসেন, তাছাড়া এন না থাকায় নিউসালেমে থাকা সম্ভব ছিল না।

স্প্রিংফিল্ড এ যাওয়ার পর লিঙ্কন যার সাথে থাকতে শুরু করেন, তার নাম যশুয়া স্পিড।

যেহেতু লিঙ্কনের আর্থিক অবস্থা করুন ছিল, তাই যশুয়া তাঁকে কোনোরকম ভাড়া ছাড়া থাকতে দিতেন। তাছাড়া নিজের একাকিত্ব দূর করার জন্য কিছু বন্ধুও পেয়েছিলেন, যাঁর মধ্যে উইলিয়াম বাটলার ও বিলি হার্নডন বিশেষ ছিলেন। যে জন টি স্টুয়ার্ট তাঁকে একসময় আইন পড়তে সাহায্য করতেন, তিনিই একসময় লিংকনকে তাঁর অংশীদার বানিয়ে নেন। সময় নিজের গতিতে চলছিল, আইন ব্যবসা কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল। লিঙ্কন ভাবতে শুরু করেন আবার তার পুরোনো সেই দোকান শুরু করার কথা। এমন সময় তাঁর পরিচয় হয় এডওয়ার্ড পরিবারের সাথে, ১৮৩৯ সালের কোনো এক সময় মিসেস এডওয়ার্ড এর ছোট বোন মেরি টড এর সাথে ও লিঙ্কনের পরিচয় হয়। মেরি ছিলেন অসম্ভব উচ্চাকাঙ্খী আর লিঙ্কন ঠিক তার বিপরীত মাটির মানুষ। মেরি বলতেন তিনি তাঁকেই বিয়ে করবেন যাঁর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, আর লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা তখন সপ্নেও ভাবতে পারেননি। যদিও দুজনের সাথে কারো কোনোরকম মিল ছিল না তবু কোনো এক কারনে দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে আর ১৮৪০ এ তাঁরা বিবাহের ঘোষণা করেন। প্রেমিকা মেরি এবং ঘনিষ্ট কিছু বন্ধুদের উৎসাহে লিঙ্কন এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহন করতে শুরু করেন। শুরু হয় আরো এক নতুন অধ্যায়।

কোনো এক অজানা কারনে মেরি আর লিঙ্কন ১৮৪১ এ বিবাহের ঘোষণা রদ করেন।

এরপরেই লিঙ্কন তাঁর বোর্ডিং বাড়ির মালকিন মিসেস বাটলার এর ছোট বোন সারা রিকর্ড কে বিবাহ প্রস্তাব দেন। কিন্তু সারা বলেন তিনি লিঙ্কনকে দাদার মতো শ্রদ্ধা করেন। তাঁর পক্ষে সেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। মেরির সাথে সম্পর্ক ভাঙার পরে লিঙ্কন আবার আগের মতো হতাশাগ্রস্থ হয়ে যান। আবার তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে শুরু করে, তখন বিখ্যাত ডাক্তার মি. হেনরির পরামর্শ অনুযায়ী সবাই তাঁকে আগলে রাখতে শুরু করেন, এখানে যশুয়া স্পীড, বিলি হার্নডন এবং ফ্রান্সিস দম্পতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। শেষমেষ ফ্রান্সিস দম্পতির হস্তক্ষেপেই ৪ নভেম্বর ১৮৪২ এ লিঙ্কন ও মেরির বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। তবে দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল তা জিজ্ঞেস না করাই ভালো হবে। তবে দাম্পত্য জীবনে ঝামেলার কারণেই প্রথমে তিনি তার অফিসে তারপরে রাজনীতিতে বেশি বেশি করে অংশগ্রহন করতে শুরু করেন। কিন্তু ১৮৪৬ র আগে তাঁকে দুইবার হতাশ হতে হয়। ১৮৪৭ সালে তিনি House of Representetive এর ভোট অংশগ্রহন করেন, কিন্তু ভাগ্য তাঁর ভাগ্যে হোঁচট ছাড়া কিছুই দেয়নি, আর তিনি আবার একবার আইনের ব্যবসায় ফিরে আসেন। সময় নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে, আর চলে আসে ১৮৫৪, যখন তিনি U.S. Senate হওয়ার জন্য ভোট দাঁড়ান, আর আগের মতোই তিনি সজোরে হোঁচট খেয়ে ভোট হেরে যান। কিন্তু তিনি হতাশ হয়ে পড়েননি আর, আগের মতোই রাজনীতিতে অংশগ্রহন করতে শুরু করেন। ১৮৫৬ তে নিজের আর মেরির ভাঙা স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছে নিয়ে তিনি Vice president এর ভোটে দাঁড়ান, কিন্তু ভাগ্যের অন্যকিছু ইচ্ছে ছিল। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৭ বছর। আবার ১৮৫৮ সালে তিনি U.S. Senate হতে যান, আর বিফল হয়ে ফিরে আসেন। এরপরে আসে ১৮৬০, যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য ভোট দাঁড়ান। এবং ভাগ্য হয়তো এটাই চাইছিল তাঁর থেকে। যেমন বার বার তপ্ত হয়ে লোহা ইস্পাত হয়ে যায়, লিঙ্কনও ঠিক তেমনই হয়েছিলেন। তিনি বিপুল পরিমান ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। তিনি মোট ১৮৭৬৯৫৭ টি ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, যা মোট প্রাপ্ত ভোটের ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিল। এখন তিনি আমেরিকার ১৬ তম রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। এবার দেখা যাক সেসময় আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আমেরিকার জনগণ তখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। উত্তর আর দক্ষিণ, এর প্রধান কারন ছিল দাসপ্রথা। উত্তরের লোকেরা আর সরকার চাইছিলো দাসপ্রথা শেষ করতে, কিন্তু দক্ষিণী রাজ্যের লোকেরা চাইছিলো দাস প্রথা অক্ষুন্ন রাখতে, এবং এর জন্য জন্য মরণপণ লড়াই পর্যন্ত করতে প্রস্তুত। এজন্যই আমেরিকা এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল, যার নিশ্চিত ফল ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভাগে ভেঙে যাওয়া। এমনই এক সংবেদনশীল মুহূর্তে আমেরিকা তার ১৬তম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এমন একজনকে বেছে নিলো, যিনি খুব বড় মাপের ও মহৎ দয়ালু হৃদয়ের মানুষ এবং সর্বোপরি তিনি নিজে ক্রীতদাস প্রথাকে ঘৃনা করতো,হয়তো সেজন্য তাঁর হাত ধরেই আমেরিকা তথা বিশ্ব এমন এক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চলেছিল। যে ঘৃণার আগুন কয়েকদশক ধরে মনে মনে জ্বালিয়ে আসছিলেন, সেই আগুনে ঘৃতাহুতি করলো হ্যারিয়েট বিচার স্টো (Harriet Beecher Stowe) র লেখা একটি বই আংকেল টম এর কেবিন (Uncle Tom's Cabin).

১৮৬১ থেকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেটি প্রায় ৮ বছর ধরে চলেছিল,কিন্তু এটি ভয়ঙ্কর রূপ তখন ধারণ করে যখন লিঙ্কন মুক্তিসনদ এর রচনা করেন। এবং ১লা জানুয়ারি ১৮৬৩ সরকারিভাবে সাক্ষর করেন। এই স্বাক্ষরিত দলিল ঠিক আমেরিকার জর্জ প্ৰথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াসিংটন এর "স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মতোই মহামূল্যবান ছিল, কারন এই একটি স্বাক্ষরের ফলে প্রায় চল্লিশ লক্ষ হতভাগ্য ক্রীতদাসসেরা দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে চিরতরেই মুক্তি পেয়েছিলেন।

কিন্তু সেই মুক্তিদান উত্তরাঞ্চল বা সরকারের জন্য মোটেও সহজ ছিল না, কারন গৃহযুদ্ধ তীব্ররূপ ধারণ জেরে, তৎকালীন আমেরিকার সেনাবাহিনীতে প্রধান সেনাপতি হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি একজনই ছিলেন, জেনারেল রবার্ট ই লী। লী সেই ভাতৃঘাতী যুদ্ধে উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ সরকারের সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন, লীর চেয়ে দক্ষ রণনিপুণ সেনাপতি পুরো আমেরিকায় আর কেউ ছিল না তখনও। লী দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন তাই ধর্মভীরু লী দক্ষিণাঞ্চলের পক্ষেই থেকে গেলেন। যদিও তিনি মনে প্রাণে দাসপ্রথাকে ঘৃণা করতেন। লী দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন তাঁকে বিশ্বাস করতেন ও মনে প্রাণে প্রধান সেনাপতি রূপে চাইতেন। কিন্তু বাধ্য হয়ে জেনারেল ম্যাকডোয়েল কে সেনাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। এছাড়া লিঙ্কন ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্র রক্ষার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে দাসপ্রথার জন্য নয়, ফলস্বরূপ প্রায় ৭৫০০০ সেচ্ছাসেবক সৈন্য যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার কোনোরকম সুবিধা করতেই পারলো না, একের পর এক যুদ্ধে দক্ষিণী বাহিনী সরকারের বাহিনীকে পরাস্ত করে যাচ্ছিলো জেনারেল লীর অতি দক্ষ রণকৌশলের ফলে। লিংকন আবার জর্জ বি. ম্যাকক্লেল্যানকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। ম্যাকক্লেল্যান বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে কুচকাওয়াজে নিযুক্ত করলেও আক্রমন করতে ভয় করছিলেন, যুদ্ধে তাঁর তৎপরতা ছিলই না উল্টে নিজেকে লিঙ্কন এর থেকে বড় বলে ভাবতেন। সময় দপ্তরের সেক্রেটারী স্ট্যান্টন যিনি নিজেও লিঙ্কনকে কথায় কথায় ছোট করার চেষ্টা করতেন তিনিও বলেই ফেলেন " ম্যাকক্লেল্যানের দশ লক্ষ্য সৈন্য থাকলেও সে বলতে পারে বিশ লক্ষ্য নাহলে সে যুদ্ধ করবে না। এদিকে একের পর এক যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের কষ্ট, শতশত সৈনিক মৃত্যু অপরদিকে নিজের সন্তান উইলী র অসুস্থতা দিনের পর দিন লিঙ্কন দম্পতি তার সেবা করেই চলতেন। লিঙ্কন এসময় প্রায় সারারাত নিদ্রাবিহীন রাত কাটিয়ে ফেলতেন। এমন সময় ১৮৬২ সালে তাঁর সন্তান উইলীর মৃত্যু হয়। লিঙ্কন শোকে কষ্টে মুচড়ে গেলেন এমন সময় তাঁর একমাত্র প্রাণশক্তি ছিল শেকস্পীয়রের কবিতা। তিনি মনের দুঃখে শুধুই শেক্সপীয়রের কবিতাগুলি আবৃতি করে চলতেন।

অপদার্থ ম্যাকক্লেল্যান কে সরিয়ে লিঙ্কন ক্রমে বার্নসাইড , হুগার, ও মীডকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। কিন্তু সুদক্ষ রণনিপুণ সেনাপতি জেনারেল লীর কাছে কেউ বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। এখানে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এটাই যে যারা অর্থাৎ যে সমস্ত ক্রীতদাসের দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে লড়াই করছিল তারা অনেকদিন ধরে বুঝতেই পারেনি যুদ্ধে হেরে গেলেও আসল জয়টা হবে তাদেরই। ক্রীতদাস কৌশলে তাদের থেকে এই কথা লুকিয়ে রেখে দেয়। এছাড়াও তারা নিজে মুক্তির কথা শুনলেও বিশ্বাস করতে পারতো না, তাদের মনে হতো প্রভুসেবায় হলো তাদের জীবনের লক্ষ। এর পরেও দলে দলে ক্রীতদাস যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালতে শুরু করে। আর এদিকে উত্তরাঞ্চল এর ভাগ্য উদয় হলো, বহু অপেক্ষার পর লিঙ্কন একজন অত্যন্ত দক্ষ্য রণনিপুণ সেনাপতিকে প্রধান সেনা প্রতি হিসেবে পেয়েছিলেন। তিনি হলেন জেনারেল ইউলিসিস এস গ্র্যান্ট (Ulysses S. Grant)। যিনি পরবর্তীতে আমেরিকার ১৮ তম রাষ্ট্রপতি হন। গ্র্যান্ট এর বীরত্বে ও কৌশলে যুদ্ধের চাকা হঠাৎ ঘুরে গেল। গ্র্যান্ট ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নিয়মানুবর্তী, নিষ্ঠুর ও দুর্ধর্ষ একজন যোদ্ধা। যাঁকে একসময় মদ্যপান ও ধূমপায়ীতার জন্য সময় দপ্তর থেকে ছাঁটাই করা হয়, তাঁর হাতেই সেদিন আমেরিকার সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল, এবং পরবর্তীতে তাঁরই হাতে পুরো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব। জেনারেল গ্র্যান্ট ১০ই মার্চ ১৮৬৪ সালে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন, আর ৯ই এপ্রিল ১৮৬৫ তে জেনারেল লি বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পন করেন। অর্থাৎ যে কাজ করতে পূর্ববর্তীদের এত লম্বা সময় লাগলো বসেই কাজটি পাত্র তেরো মাসেই জেনারেল গ্র্যান্ট করে দেখিয়েছিলেন। আর জেনারেল গ্র্যান্ট এর নিযুক্তি রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন করেছিলেন, এর থেকে বোঝা যায় লিঙ্কনের দূরদর্শিতা কতখানি। জেনারেল লী আত্মসমর্পন করার পরে লিঙ্কন সেটা করেন যেটা হয়তো আগে আর কেউ করেনি। তিনি আত্মসমর্পনকারী সৈনিকদের তাদের অস্ত্রসহ প্রবেশের অনুমতি দেন। এর কারন হিসেবে তিনি বলেন " একজন সৈনিকের থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার মতো অসম্মান আর হয়না, আর সৈনিকদের এমন অসম্মান এর কারন আমি হতে চাই না ।"

জেনারেল এডওয়ার্ড লী আত্মসমর্পন করার পরে লিঙ্কন যেটা করান সেটা হয়তো আগে আর কেউ করান নি। তিনি আত্মসমর্পনকারী সৈনিকদের তাদের অস্ত্রসহ স্বসম্মানে প্রবেশের অনুমতি দেন। এর কারন হিসেবে তিনি বলেন " একজন সৈনিকের থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার মতো অসম্মান আর হয়না, আর সৈনিকদের এমন অসম্মান এর কারন আমি হতে চাই না"

এর থেকেই লিঙ্কনের মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন শত্রুতাকে একমাত্র বন্ধুত্ব দিয়েই শেষ করা যায়।

এর পরে সময় শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায় গুলির একটি, লিংকন হত্যা ও ষড়যন্ত্র।

চার বছরের মহা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যেই লিঙ্কন হত্যার অনেক ষড়যন্ত্র হয়, অনেক সমিতি ও তৈরী করে দক্ষিণাঞ্চলের খামার ও ক্রীতদাস মালিকেরা, কিন্তু কেউই সফল হয়না, উল্টে লিংকন তাঁর শত্রুদের বন্ধুতে প্রিন্ট করে ফেলেন। তাহলে এই জঘন্য অসাধ্য কাজটি কে করেছে ?

আর কোন উদ্দেশ্যেই বা করেছে?

যে এই জঘন্য কাজটি করেছে সে কোনো রাজনৈতিক দলের বা গুপ্তঘাতক সমিতির সাথে জড়িত ছিল না। দক্ষিণাঞ্চলের সাথে ও তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার একটিই উদ্দেশ্য ছিল রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া। আর এর জন্য তার সবচেয়ে সহজ মনে হয়েছিল মহান লিঙ্কনকে হত্যা করা।

মহান লিঙ্কনকে কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার পরে বুথ সবকিছু ঠিক করে ফেলে। সেদিনটি ছিল ১৪ই এপ্রিল সেদিন যখন একজন জেনারেল পলাতক সৈনিকের প্রাণদণ্ডের আদেশপত্রে সই করতে বলেন, তখন লিঙ্কন হেসে বলেন "আমার মনে হয় ছেলেটি মাটির নিচে না থেকে উপরে থাকলেই, বেশি কিছু ভাল করতে পারবে" এবং এটা বলেই লিঙ্কন সেই সৈনিকের মার্জনা পত্র স্বাক্ষর করেন। এটিই ছিল লিঙ্কনের জীবনের শেষ সরকারী কাগজে স্বাক্ষর। ১৪ই এপ্রিল গুড ফ্রাইডে ছিল, পুরো আমেরিকা সেদিন যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতার আনন্দে আনন্দিত ছিল। বিশেষ করে ওয়াশিংটন ডিসিতে উৎসবমুখর আবহাওয়া ছিল। লিঙ্কনও অনেকদিন পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন, তাই তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে নাটক দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেইমত ফোর্ড থিয়েটার বুক করে নেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির জন্য। রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন ও মেরী টড লিঙ্কন এবং মেজর রথবোন ও তাঁর প্রেমিকা ক্লারা হ্যারিস এর সঙ্গে উপযুক্ত সময়ে থিয়েটারে পৌঁছে যান। সেখানে জনতার অভিবাদন গ্রহণ করার পরে রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন থিয়েটার এর ভেতরে প্রবেশ করেন এবং নিজের আসনে বসে একাগ্রচিত্তে নাটক দেখতে থাকেন। আওয়ার আমেরিকান কাজিন (Our American Cousin) নাটকটি সময় মতো শুরু হয়। সময় নিজের গতিতে দৌড়াচ্ছিল, সময় রাত্রি দশটা বেজে দশ মিনিট, বুথ থিয়েটারের মধ্যে প্রবেশ করে। লিঙ্কনের দেহরক্ষীরা তাকে আটকালে নিজের অভিনেতা হওয়ার প্রমাণ পত্র দিয়ে সে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এরপরে সে আস্তে আস্তে পিস্তল বের করে এবং গুলি চালিয়ে দেয় লিঙ্কন হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন এমন সময় মেরী টড লিঙ্কন চিৎকার করে "ও ও প্রেসিডেন্ট কে খুন করেছে।" মেজর রথবোন রক্ষীদের আদেশ করেন "ওই লোকটিকে ধরো সে প্রেসিডেন্ট কে খুন করেছে" হঠাৎই জনতা বেকাবু ও উন্মত্ত হয়ে যায়। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ বলতে শুরু করে থিয়েটার হলে হয়ত বোম্ব আছে এবং ভিড়ের সুযোগে বুথ পালিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তার আসে এবং ডাক্তারের কথা অনুযায়ী থিয়েটার থেকে বের করে একটি ছোট সরাইখানা তে নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি লিঙ্কনের উপরে হামলার কথা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে এটাও গুজব ছড়াতে শুরু করে রাষ্ট্রপতি লিঙ্কন নিহত হয়েছেন, এও গুজব ছড়াতে শুরু করে উপরাষ্ট্রপতি জনসন ও সেক্রেটারি স্ট্যানটন নিহত হয়েছেন। গুজব ছড়ায় বীর সেনাপতি জেনারেল গ্র্যান্ট ও জঘন্য ভাবে আহত হয়েছেনা। গুলি বাম কানের মধ্যে দিয়ে লিঙ্কনের মাথায় ঢুকে যায়। মহান লিঙ্কন মৃত্যু এবং জীবনের মাঝখানে মাত্র ৯ ঘণ্টার মতো অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এরপর সময় আছে ১৫ই এপ্রিল ১৮৬৫ দিন সকাল ৭ টা ২২ মিনিটে ডাক্তারেরা হার মানতে বাধ্য হয় এবং আমেরিকার প্রিয় রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন চিরতরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শেষ হয় এক মহান রাষ্ট্রপতির জীবন সংগ্রাম। বহু কষ্টের এবং পরিশ্রমের পরে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর অনেক পরিশ্রমের ফলে ২৫ সে এপ্রিল জনৈক কর্নেল কনজার এর গুলিতে বিদ্ধ হয়ে আহত হয় এবং মারা পড়ে । তাকে জীবিত ধরা যায়নি কিন্তু তার বাকি সঙ্গীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল। ৪ মে লিঙ্কনকে তার প্রিয় শহর স্প্রিংফিল্ডে সমাধিস্থ করা হয়।

লিঙ্কন সত্যিই তার শত্রুদের বন্ধু বানিয়ে ছিলেন। তাঁর চরম বিরোধী স্ট্যান্টন লিঙ্কনের শায়িত দেহের পাশে দাঁড়িয়ে অবরুদ্ধ কন্ঠে বলেছিলেন "ওই দেখো আমেরিকাবাসী , শুয়ে আছে আমেরিকা তথা বিশ্বের সর্ব সেরা রাষ্ট্রপ্রধান"

লিঙ্কনের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী চেজ লিঙ্কনের কফিনের ওপরে বারবার কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

লিঙ্কনের হত্যাকারীকে আজ কেউ চেনে না, মনে রাখেনি কেউ। কিন্তু মহান রাষ্ট্রপতি লিঙ্কনকে আজ পৃথিবীর প্রতিটি কণার মানুষ চেনে, মানুষ জানে, মানুষ ভালোবাসে, যেখানে যেখানে মানুষের বাস সেখানেই লিঙ্কন মানুষের হৃদয়ে আছেন মহান এই রাষ্ট্রপতি।