মাইকেল এ. সিঙ্গার হলেন একজন আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক। তিনি পাঠকমহলে পরিচিত তাঁর আধ্যাত্মিক এবং দর্শনের উপর লেখা বই এবং তত্ত্বের জন্য। ২০১৫ সালের তাঁর বই “সারেন্ডার এক্সপেরিমেন্ট “ নিউ ইয়র্ক এর সর্বাধিক জনপ্রিয় পুস্তক।

তিনি এই বই এর ভূমিকা তে বলেছেন আমাদের জীবনে অনেকরকম ইচ্ছা, চাহিদা থাকে এবং সেইসব ইচ্ছার এক বিরুদ্ধ শক্তি কাজ করে। আমরা সাধারনত যা প্রার্থনা করি তা অনেকসময় বাস্তবের পরিপন্থী এবং তখন আমাদের অপূরণীয় ইচ্ছা গুলির সাথে ব্যস্ত জীবনের সংঘাত আমাদের জীবনকে কঠিন করে তোলে। তিনি এর উপায় হিসাবে এক ব্যাবহারীক গবেষণার কথা বলেছেন। পৃথিবীর এক অফুরন্ত প্রানশক্তি রয়েছে যার সাহায্যে ডিএনএ এর প্রক্রিয়াকরণ, একটি সাধারণ কোষ থেকে প্রাণীর জন্ম এবং একটি ছোট্ট বীজ থেকে বৃহৎ মহিরুহের জন্ম সম্ভব। তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত কাজ এবং ইচ্ছা আমাদের ব্যাক্তিগত অধীনতার সীমা থেকে অতিক্রম করে সেই বৃহৎ শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে , তবে সব দিক দিয়ে আমরা সুখে জীবনযাপন করতে সক্ষম হবো। এই পরীক্ষার নাম তিনি দিয়েছেন, “সরেন্ডার এক্সপেরিমেন্ট”।

অধ্যায়-১

ঘুম থেকে জাগা-

তিনি প্রথমে তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ৬ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর ডাকনাম ছিলো মিকি। তিনি ফ্লোড়িডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শেলি কে বিবাহ করেন এবং তাঁর ভাই রনির বন্ধু হয়ে ওঠেন। কিন্তু রনির সাথে কথোপকথনের সময় তিনি অনেকসময় অস্বস্তি অনুভব করতেন, তিনি ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র এবং ধর্ম, দর্শন এইসব বিষয়ে তিনি স্বছন্দ বোধ করতেন না, এইরমকম এক দিন ১৯৭০ এর শীতে তিনি রনির সাথে কথা বলার সময় আবিষ্কার করলেন তাঁর ভেতরের এক আওয়াজ বা সত্ত্বা যার অধীনে তিনি কাজ করে চলেছেন । সেই অন্তমুখী সত্ত্বা সবসময় তাঁর প্রথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে চলেছে। তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন কারণ ধীরে ধীরে এই ভেতরের কণ্ঠস্বর তাঁর নির্দেশক হয়ে উঠেছিল। একদিকে তিনি চাইছিলেন এই অন্তর এর আওয়াজকে পরিত্যাগ করতে আবার সেই শক্তির বিষয়ে জানার ব্যাপারেও কৌতূহলি হয়ে পড়েছিলেন।একদিন মার্ক ওয়ার্ল্ডমান বলে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে জেন বুদ্ধিজম এর উপর এক বই পড়তে দিল যা পড়ার পর তাঁর জীবন আমূল পরিবর্তন হলো। তিনি সেই অন্তরের কণ্ঠস্বর সম্পর্কে অবহিত হলেন। তখনো তিঁনি ধ্যানের ব্যাপারে কিছু জানতেন না। সেই পুস্তকে বলা হয়েছিল শান্তভাবে একটি জায়গায় বসে, নিঃস্বাস নেওয়া এবং ছাড়ার সময় ‘মু’ এই অক্ষর উচ্চারণ করতে। একদিন তিঁনি এক নির্জন শান্ত বনের মধ্যে এটি অভ্যাস করলেন ভালোভাবে এবং অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলেন। তিঁনি ওই জেন পন্থা অনুযায়ী ধ্যানে বসলেন। নিঃস্বাস প্রস্বাসের গতি বাড়ালেন এবং তাঁর তলপেটের মাধ্যমে তাঁ নিয়ন্ত্রণ করলেন এবং ‘মু’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। এভাবে তিঁনি এক অদ্ভুত এবং প্রেরণাদায়ক শক্তি লাভ করলেন, তাঁর দেহ এবং মন অবশ হয়ে এলো। এতদিন ধরে যে অন্তমুখী শব্দ তিঁনি শুনছিলেন তাঁর পরিবর্তে এক অদ্ভুত আওয়াজ শুনলেন যা তাঁকে আদেশ দিলো এই পক্রিয়া চালিয়ে যেতে এবং তাঁর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে। তিঁনি বেশ কিছু বার ধ্যান এর ভেতরের স্তরে পৌঁছে গেলেন এবং শেষে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলেন। বাইরের প্রকৃতি, বিশ্ব, গাছপালা সব কিছুর মধ্যে এক স্বর্গীয় আনন্দ এবং শান্তভাব খুঁজে পেলেন। তিঁনি এক সমাধির স্থানে তাঁর আত্মা কে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তাঁর মনে হলো তাঁর নতুন করে জন্ম হয়েছে, সব কিছুর মধ্যে এক শান্ত এবং নির্জনতার ছায়া তিঁনি খুঁজে পেলেন। যখনি সময় এবং সুযোগ পেতেন, তিঁনি সেই বিশেষ পক্রিয়া করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাস্তব ঘাত - প্রতিঘাতের আক্রমণে সেই শান্তভাব কমে আসতে লাগলো। তিঁনি অন্তরে এক শক্তির প্রবাহ খুঁজে পেলেন যা তাঁর আগে খুঁজে পাওয়া কণ্ঠস্বর কে পিছিয়ে তাঁর মন এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার এক স্থির,নীরব ভাব উদ্ভাসিত করলো। তিঁনি তাঁর স্ত্রী কে ত্যাগ করলেন এবং বিয়োগ- যন্ত্রনা যে এক তীব্র অনুভূতি তার শিক্ষা লাভ করলেন। তিঁনি প্রায় এক সাধুর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যেখানে নিজের অস্তিত্ব সন্ধানের প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। তাঁর গ্র্যাজুয়েশন এর পরীক্ষার পর তাঁর এক বন্ধুর পরামর্শে তিঁনি মেক্সিকো ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মেক্সিকোর অপরূপ প্রকৃতির শোভা তাঁকে মোহিত করেছিল। তিঁনি সেখানে এক জঙ্গল এবং এক পাহাড়ে ধ্যান এবং ‘মু’ ধ্বনি জপ করতেন এবং সেই অফুরান প্রানশক্তি অনুভব করতেন। একদিন এক আট বছরের বালক তাঁর জন্য দুধ নিয়ে এলো যা তার মা পাঠিয়েছেন, মিকির হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে উঠলো।

একের পর এক সুন্দর অভিজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একদিন সেখানকার এক ছোট্ট গ্রামের অধিবাসিদের কয়েকজন এর সাথে তাঁর দেখা হলো এবং খুব সহজে তাঁরা বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। তিঁনি তাদের গ্রাম দেখতে গেলেন। তাদের জীবন ছিলো ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়।

তাঁরা মিকি কে আপন করে নিলেন এবং লেখক যখন তাদেরকে সামান্য সাহায্য করলেন তাঁরা অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন। লেখক বুঝলেন জীবনকে আমরা যেভাবে পরিচালিত করতে চাই, অনেক সময় কোনো প্রচেষ্টা ছাড়ায় জীবনীশক্তি আমাদের নতুন আনন্দ প্রদান করে।

এইভাবেই ধ্যান এবং বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবন কে তার মতো করে প্রকাশ করার অনুমতি এবং তার মাধ্যমে যে আপার আনন্দ লাভ করা যায় তার কাহিনী তিঁনি বলেছেন। তিঁনি তার ডক্টরাল থিসিস্ এর জন্য এই অবিরাম শক্তির প্রবাহ বা সৃজনশীলকাজের অনুপ্রেরণার সাহায্য পেয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন সৃজনশীল শক্তি যুক্তিবাদী চিন্তার থেকে অনেক এগিয়ে।

লেখক বেশকিছুদিন গৃহপরিত্যাগ করে ওকালা জাতীয় আরণ্যে বসবাস করে অনুশীলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন , কিন্তু তারপর তিঁনি বুঝতে পারলেন যে একটি স্থায়ী বাসভূমি তাঁর প্রয়োজন। তিঁনি গ্রাইন্সভিলে একটি ৫ একর এর এক সুন্দর বাড়ি পেলেন যার সামনে উন্মুক্ত জঙ্গল এবং কিছু অংশ খোলা জায়গা। তাঁর ফেলোশিপ বাদে যে অর্থ তাঁর পিতা দিয়েছিলেন তা দিয়ে তিঁনি সেই সুন্দর বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন তাঁর সাধনার জন্য।

তিঁনি এবং বব গৌল্ড ছিলেন বিদ্যালয় থেকে ভালো বন্ধু, বব এবং ববি আলটম্যান বলে একজন বন্ধুর সাহায্যে তিঁনি একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর বানাতে পেরেছিলেন যেখানে তিঁনি এবং তাঁর বন্ধু একান্তে সেই আপার্থিব শান্তি এবং স্বাধীনতার খোঁজ পাবেন। তিঁনি কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে নিজের জীবনকে বেঁধে ফেলেছিলেন। ভোর ৩ টের সময় ঘুম থেকে উঠে ধ্যান -অনুশীলন, খাদ্যভাস এর উপর নিয়ন্ত্রণ, সঠিক নিদ্রা এসবের মাধ্যমে তিঁনি প্রকৃত এক বৌদ্ধদের জীবনপদ্ধতি রপ্ত করেছিলেন।

এরপর বব মেরিল বলে এক বন্ধু তাঁকে ভারতের এক ঋষি স্বামী যোগানন্দের এক পুস্তক দেন যাতে সেই ঋষির ধর্মীয় শিক্ষার বর্ণনা ছিলো। এই বই লেখক কে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং তিঁনি সেই অফুরান শক্তি বা শান্তির প্রবাহের সঙ্গে স্বামীজীর আত্মজ্ঞান বা তৃতীয় দিব্য চক্ষুর মিল খুঁজে পান। আত্মা বা জীবের সত্যরূপ সম্পর্কে তিঁনি ধারণা লাভ করেন এবং ভগবান তাঁর কাছে একটি সাধারণ শব্দ থেকে তাঁর অন্তিম গন্তব্যস্থল হয়ে উঠলো।

অধ্যায় -২

মহান পরীক্ষার আরম্ভ -

তিঁনি তাঁর ধ্যান -অনুশীলন এর মধ্যে তাঁর বাহ্যিক মনের বাধাদান নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে বুঝেছিলেন তাঁর পছন্দ-অপছন্দ গুলির তালিকা তাঁর মানসিক অশান্তির কারণ। তখন তিঁনি চেষ্টা করেছিলেন প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে বিলিয়ে দেওয়ার। বৃষ্টির জন্য প্রকৃতিকে অপমান না করে এবং নিজের

ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা কে প্রাধ্যান্য না দিয়ে প্রকৃতির আশীর্বাদ এবং তার সৌন্দর্যকে বিচার করা উচিত। প্রকৃতির মধ্যে যে অপার শক্তির প্রবাহ তার প্রতি নিজের জীবনের আগামীর পথ সমর্পন করলে আখেরে একজন মানুষ বিশ্বপিতার আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবেন। এইসবকিছুর মধ্যেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল থিসিস এর জন্য,তাঁকে ছাত্রদের ক্লাস নিতে হতো। তিঁনি তাঁর প্রতিদিনের অনুশীলন করে, ক্লাস শেষ করেই আবার তাঁর সেই সুন্দর বাড়িতে ফিরে আসতেন। একদিন তিঁনি জামা না পরেই ক্লাসে চলে গিয়েছিলেন এবং তাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ করেননি। এইসময় এক নতুন স্থাপিত কমিউনিটি কলেজের সভাপতি অ্যালেন রবার্টসন এর সঙ্গে তিঁনি সহকারী হিসাবে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাবার আদেশ পান। প্রথমে তিঁনি আপত্তি করতে চাইলেও তিঁনি জীবনীশক্তির উপর নিজের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর অধ্যাপক গফম্যান এর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন। অ্যালেন এর সঙ্গে তাঁর এক গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, যদিও অ্যালেন বারবার জেদ করেছিলেন তাঁর কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদানের কিন্তু লেখক তাতে রাজি হননি। এরমধ্যেই অর্থনীতির এক পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয়েছিল যার জন্য তিঁনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। প্রথমে তিঁনি ভেবেছিলেন পরীক্ষা দেবেন না, পরে গভীরচিন্তা করলেন যে তাঁর মন তাঁর আশু- প্রকাশ্য ব্যার্থতার ভয়ে এই পরীক্ষায় বসতে রাজি হচ্ছেনা। তিঁনি এই ব্যার্থতার ভয় কে বধ করার জন্য আবার নিজেকে সেই শক্তির প্রবাহের কাছে আত্মসমর্পন করলেন। তিঁনি পাঠ্যপুস্তকের কিছু অংশ মাত্র প্রস্তুতি নিলেন এবং ঠিক সেই অংশ থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল। তিঁনি আরো একবার প্রমান পেলেন জীবন এবং প্রকৃতির কাছে নিজের চাহিদা বিসর্জনের মাধ্যমে অনেক অভুতপূর্ব আনন্দ পেতে পারেন।

এর মধ্যে ১৯৭২ সালে গবেষণার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তিঁনি যোগানন্দের কিরিয়া যোগ সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আত্মজ্ঞান সংক্রান্ত যে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে অনুরোধ করলেন এই যোগ তাড়াতাড়ি শেখানোর জন্য কিন্তু তাঁকে আর ও ৬ মাস অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। এর ই সঙ্গে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যেখানে যোগানন্দের এক অনুগামীর কাছ থেকে কিরিয়া যোগ শিক্ষার আমন্ত্রণ পেয়ে আনন্দিত হলেন। এই প্রসঙ্গে তিঁনি জীবনের কাছে আত্মসমর্পনের ২ টি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত নিজের ব্যাক্তিগত পছন্দ - অপছন্দের তালিকা বাদ দিতে হবে এবং এবং সম্পূর্ণ পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করতে হবে। অ্যালেন এর অনুরোধে তিঁনি সান্টা ফে কলেজে শিক্ষক হিসাবে প্রথমবারের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন। তিঁনি ছাত্রদের ধ্যান - অনুশীলন এবং ভেতরের শক্তির যে প্রবাহ তাঁর শিক্ষা দেখয়ার প্রস্তাব দেন এবং তা মঞ্জুর হয়। এরপর তিঁনি তাঁর আমন্ত্রিত যোগানন্দের কিরিয়া যোগ শেখার জন্য ক্যালিফোরনিয়া যাত্রা করেন। সেখানে তিঁনি এক স্বপ্নে এক গুহার ভেতর দিয়ে আত্মনুসন্ধান এবং সব শেষে এক উজ্জ্বল জ্যোতি আবিষ্কার করেন এবং তিঁনি বুঝতে পেরেছিলেন এই স্বপ্ন তাঁর কাছে একটি প্রতীক, তাঁর আত্মনুসন্ধানের।

তিঁনি সেই স্বপ্নের পর একটি নতুন পথ আবিষ্কার করলেন যার মাধ্যমে তিঁনি তাঁর বস্তুগত মানসিক সত্ত্বা কে তাঁর আধ্যাত্মিক উন্নতির পথের বাঁধা হিসাবে না পর্যবেক্ষণ করে, সেই সত্ত্বাকেও স্বাধীনতা দিয়ে, ভালোবেসে এবং আর ও বেশি জীবনের কাছে নিজের চলার পথকে মসৃন করে তুলতে পারে।

সান্টা ফে কলেজের এক ছাত্রী স্যান্ডি তাঁর বাড়িতে কিছু বন্ধুদের সাথে আসতেন সন্ধ্যাবেলার ধ্যানের জন্য। একদিন লেখক বাড়ি ফিরে দেখলেন স্যান্ডি এবং বব এই সুন্দর শান্তির স্থানে আর ও একটি নতুন বাড়ি বানাচ্ছে তাঁর জন্য।তার ধর্মীয় অনুশীলন এর জন্য সে কথা দিচ্ছে,সে চলে যাবার পর বাড়ির অধিকার লেখকের হবে। লেখক প্রথমে রেগে গেলেও নিজের মনকে শান্ত করলেন এবং ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন যে আর ও একটি সুন্দর বাড়ি তৈরি হচ্ছে তাঁর জায়গায় এবং তিঁনি নিজে সেই বাড়ি তৈরির কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিঁনি বুঝতে পারলেন তিঁনি স্যান্ডি বা নিজের জন্য না, সেই বৃহৎ শক্তির কাছে নিজের কাজ কে উৎসর্গ করেছেন। তিঁনি তাঁর ক্লাসে একের পর এক গভীর বক্তব্য পেশ করেছিলেন নিজেকে জানার উপায় নিয়ে যার ফল হয়েছিল ছাত্রসংখ্যা দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। তিঁনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক অনুশীলন এর সঙ্গে তাঁর ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়ার কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই দুটি ক্ষেত্রেই তিঁনি সেই অসীম জীবনীশক্তির মুখোমুখি হোন এবং দুটি ক্ষেত্রেই অনুভব করেন আত্মসমর্পণ এবং সেই আশ্চর্য ঘটনাপ্রবাহের ফল।

এইসময় বব টিলচন বলে এক ব্যক্তি তাঁর বাড়ির এক অংশ কিনে নেন। তিঁনি একদিন লেখকের অনুরোধ করলেন মেক্সিকোর এক জেলে তার বন্ধু জেরির সাথে দেখা করার। লেখক দেখা করলেন এবং জেরির মেডিটেশন নিয়ে আগ্রহ লক্ষ্য করে তিঁনি সেখানে কিছুক্ষন ধ্যান- অনুশীলন করলেন। এরপর ফ্লোড়িডা স্টেট প্রিসনে তিঁনি আরো বেশ কিছুজন আগ্রহী ব্যাক্তির সাথে প্রার্থনা সভায় মিলিত হতেন।

অধ্যায় -৩

নির্জনতা থেকে সেবা -

এই অধ্যায়ে তিঁনি তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী শেলির সাথে দেখা করলেন সানফ্রান্সসিকো তে যেখানে শেলি তাঁর বাড়িটিকে একটি ধ্যান -অনুশীলন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। সেখানে তিঁনি এক ভারতীয় যোগীর (বাবা ) এর ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। তিঁনি সেখানে বেশ কিছুক্ষন ধ্যান - অনুশীলন করলেন এবং ঘর টি যেন শক্তির প্রবাহে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। পরে তিঁনি জানতে পেরেছিলেন ইনি হলেন স্বামী মুক্তানন্দ এবং তাঁর ছবি আবিষ্কার করলেন স্যান্ডি এর এক বন্ধু রামা ম্যালনের কাছে যাকে স্যান্ডি ভ্রমণে গিয়ে তাঁর বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। ম্যালন তাঁকে অবহিত করলেন বাবা মুক্তানন্দ আগামী বসন্তে আমেরিকা আসার পরিকল্পনা করেছেন এবং অনুরোধ করলেন তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর।

লেখক একটি চিঠি লিখলেন এবং বাবার এক প্রতিনিধি জানালেন বাবা এবং তাঁর শিষ্য দের যথাযথ বন্দোবস্ত করতে পারলেই বাবা আসবেন। এর মধ্যে স্যান্ডি এর এক বন্ধু যিনি এই ধ্যান -অনুশীলন এর গভীর অনুগামী- ডোনা ওয়াগনের, রবিবারের অনুশীলন এর দায়িত্ব নিলেন, এই প্রসঙ্গে লেখক তাঁর জনপ্রিয় বই “সত্যের অনুসন্ধান”(“The Search for Truth”) কথা উল্লেখ করেছেন।

এরপর তিঁনি বাবার কাছ থেকে এক আমন্ত্রণ পেলেন আটালামায় ডিসেম্বর মাসে ( গ্রান্সভিলে আসার এক মাস age) তাঁর কর্মকান্ড দেখার জন্য। এই সময় লেখক, ডোনা, স্যান্ডি এবং বাকি সবাই বাবার আসার জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিলেন এবং নীরবতা থেকে কিন্তু এখন অনেক সময় বাইরের পৃথিবীতে সময় কাটাতে লাগলেন এবং এক খোলা শক্তির সাথে নিজেকে একাত্ম অনুভব করলেন। এর ই মধ্যে তিঁনি অনুভব করলেন তাঁর উপর স্বামী যোগানন্দের প্রভাব অতুলনীয় এবং তা চিরকালীন ।

আটালামায় পৌঁছে তিঁনি বাবার শিষ্য দের সাথে ধ্যান - অনুশীলনে যোগ দিলেন। বাবার সান্নিধ্য তাঁকে আর ও বেশি উৎসাহিত করে তুলেছিল এবং একদিন বাবার স্পর্শে তিঁনি তাঁর বাহ্য চেতনা হারালেন, তাঁর মনে হলো এক বিদ্যুৎ শিখা তাঁর শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং সমাধিস্থ হলেন, তিঁনি বুঝতে পারলেন বাবা অসীম শক্তির অধিকারী।

বাবা তাঁর বাড়িতে এলেন এবং তাঁর এক শিষ্য তাঁকে বললেন তাঁর আগের অভিজ্ঞতা হলো ‘শক্তিপাত ‘ যা এক বিশেষ আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ যা বাবার কাছ থেকে তিঁনি পেয়েছেন। বাবার এই সফরেই তাঁর রনির সাথে দেখা হলো যার সাথে পেথম লেখকের এই অদ্ভুত (আক্ষরিক অর্থে )পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। রনি ছিলেন বাবার আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের প্রথম সভাপতি।

বাবার এই সফর ছিলো এক ঢেউ এর মতো, যা লেখক সহ আর অনেক আধ্যাত্মিক অন্বেষক কে নির্জনতা থেকে সেবার ধারণা প্রদান করেছিল।এবং এই সেবাই হলো লেখকের স্বপ্নে দেখা জীবনপরিচালনার অন্য পথ। এক ভারতীয় মাতাজীর সাথে লেখকের দেখা হলো এবং তিঁনি ভবিষৎবাণী করলেন যে লেখকের বাড়ির পাশে এক মন্দির তৈরি হবে এবং নির্দিষ্ট দিনে তা তৈরি হয়েছিল। জীবনের প্রতি আত্মসমর্পন এর ফলে ছিলো এই সব অদ্ভুত জীবনীপ্রবাহ। ঠিক সময়ে অর্থ, পরিশ্রম সব কিছুর বিনিময়ে এক সার্বজনীন মানবতার মন্দির তৈরি হয়েছিল যেখানে জেসাস, যোগানন্দ এবিং বুদ্ধ অর্থাৎ সব ধর্মের সারকথা একস্থানে মিলিত হয়েছিল, এ ছিলো যেন এক বিরাট মহাবিশ্বের এক ছোট্ট অথচ আলোকময় তারা বা নক্ষত্র। তিঁনি অমৃত দেশাই এর কথা উলেখ করেছেন যিনি মাতাজী এবং মুক্তানন্দ এর মতন লেখকের জীবনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। মুক্তাননদের মতন তাঁর স্পর্শে লেখক গভীর শক্তির কৃপা লাভ করেছিলেন এবং জীবন নিজেই নিজের পথ বেছে নিয়েছিল, যখন অমৃত দেশাই এর পরামর্শে সকাল এবং সন্ধের প্রার্থনায় তিঁনি নীরবতা ভেঙে বাকি মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন।

১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে তিঁনি তাঁর মানবতার মন্দির কে একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেন এবং তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে এক আধ্যাত্মিক অনুশীলনের কেন্দ্র। এই সময় ডোনার সাথে তাঁর এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তাঁরা বিবাহ করলেন

অধ্যায় -৪

আত্মসমর্পনের পদ্ধতি-

তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে আর একটি হলো ডেপুটি নোয়েলস লেখককে অনুরোধ করলেন তাঁর বাড়ি তৈরি করে দিতে এবং রাধা নামের এক সহকারীর সাহায্যে তিঁনি তা শুরু করলেন এবং এই কাজকেও জীবনের গতির কাছে নিজেকে আত্মসমর্পনের ফলাফল হিসাবে পর্যালোচনা করলেন। এর মধ্যে তিঁনি বাড়ি বানানোর এক চালু লাইসেন্স পেয়ে গেলেন। তাঁর মেয়ে দুর্গাদেবীর জন্ম হলো সেই আধ্যাত্মিক অনুশীলন কেন্দ্রে এবং তিঁনি তাঁর এক প্রতিবেশীর অনুরোধে তাঁর দুটি বাড়ি কিনে নিয়ে মন্দিরের সাথে সংযুক্ত করলেন।

এরপর এক দম্পতির অনুরোধে তাঁদের বাড়ি তৈরির জন্য, মন্দিরের নামে যে ভালোবাসার ট্রাস্ট তৈরি করেছিলেন তার নামে এক পোর্টফোলিও বানিয়ে ব্যাংকে লোনের জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু কোনো ব্যাংক রাজি হলো না। এক্ষেত্রেও তিঁনি জীবনের গতির উপর নিজেকে ছেড়ে দিলেন এবং আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বৃদ্ধির এক সুযোগ হিসাবে মনে করলেন। শেষ ব্যাংকের সভাপতি জিম ওয়েন্স সব কিছু খতিয়ে কুড়িহাজার ডলার এর লোন অনুমোদন করেছিলেন এবং লেখক এর ঠিক দশ বছর পর জিম কে সেই উদারতার প্রতিদান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যখন জিম ব্যাংকের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর নিজের স্টোরহাউস এর জন্য সমপরিমান অর্থের দরকার ছিলো।

এর মধ্যে টম জেনকিন্স ১৯৭৮ সালে , একজন পেশাদার গল্ফ খেলোয়াড়, মন্দিরের কাছে এক বাড়ি বানানোর জন্য ‘Love Build Trust” কে অনুরোধ করলেন। এর মধ্যে এক ছাত্রীর কথা তিঁনি উল্লেখ করেছেন যিনি সান্টা ফে তে তাঁর ক্লাসে আসতেন, এবং রবিবারের অনুশীলনে যোগ দিতেন। একদিন গরমের জন্য তিঁনি শ্রেণীকক্ষের জানালা খুলে দেন। অনেকদিন পর সেই ছাত্রী বলেন লজ্জায় তিঁনি প্রথমদিকে ক্লাসে আসতেন না এবং তিঁনি ভেবেছিলেন মিকি তাঁর জন্য জানালা খুলে দিয়েছিলেন, সেইসময় লেখক তাঁর গল্প বললেন এবং এই দুটি ঘটনাকে জীবনের আশীর্বাদ রূপে বর্ণনা করলেন। সেই সর্বব্যাপী কর্মশক্তি তাঁকে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার সাথে এবং তার সাথে বস্তুগত কাজের মেলবন্ধন ঘটাতে সাহায্য করে।

তিঁনি বুজেছিলেন কিভাবে একটি ছোট্ট ব্যাবসা এক ক্রমবর্ধমান আধ্যাত্মিক কাজকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তিঁনি প্রতি শনিবার প্রিসনে গিয়ে বন্দিদের মধ্যে আলোচনায় যোগ দিতেন এবং তিঁনি বুজেছিলেন লোহার দরজা শুধুমাত্র তাদেরকে দেহকেই আটকে রেখেছে কিন্তু মন তাদের অসীম স্বাধীনতায় বহমান।সেই বন্দিরা আবিষ্কার করেছিলেন অন্তরের সেই কণ্ঠস্বর এবং শিখেছিলেন সেই স্বর কে এড়িয়ে যেতে। এই প্রসঙ্গে তিঁনি ডেভিড এর কথা উল্লেখ করেছেন যিনি ছিলেন কুখ্যাত মোটরসাইকেল গ্যাং এর সদস্য। কিন্তু সে যোগানন্দের আত্মজীবনী পড়তে শুরু করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই পারমার্থিক জগৎ সম্পর্কে উৎসুক হয়ে ওঠে। স্বল্পকালের মধ্যে সে বুৎপত্তি লাভ করে এবং প্রিসনহাউসে দলনেতা হয়ে ওঠে।এর কিছুদিনের মধ্যে ডেভিড কে তার অতীত অপরাধমূলক কাজের জন্য রক এর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সে লেখককে চিঠি লিখে জানায় যে সে সারাদিন ধ্যান - অনুশীলন এর মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করছে। এর ই মধ্যে অমৃত দেশাই এর সাথে ডেভিড দেখা করতে চেয়ে এক চিঠি পাঠালেন এবং অমৃতজি রাজি হলেন। লেখক এই সাক্ষাতের আয়োজন করলেন। একটি অন্ধকার কক্ষের মধ্যে ডেভিড বন্দি ছিলেন। যখন অমৃতের সাথে দেখা হলো ডেভিড এর চোখে জল, সে এটুকু বলতে পারলো আজ তার হৃদয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। লেখক ভাবলেন ডেভিড পৃথিবীর এক অন্ধকার ছোট্ট ঘরে থেকেও তার আধ্যাত্মিক ক্রিয়া সবচেয়ে উঁচু স্থান অধিকার করেছে।

অধ্যায় -৫

কিছু অমূল্যের জন্ম -

এরই নাধ্যে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।,১৯৮০ সালে তিঁনি রেডিও শ্যাক থেকে কম্পিউটার কিনলেন এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর কাজ শিখলেন। রেডিও শ্যাক এবং সিস্টেম প্লাস সফটওয়্যার এর সাহায্যে তিঁনি প্রোগ্রামিং এর ব্যাবসা গড়ে তুললেন। জেমস পিয়ারসন এর সাহায্যে একটি প্রাইভেট জেট কিনলেন এবং বিদেশেও ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। এরপর তিঁনি ‘The Medical Manager’ নামক এক সফটওয়্যার এর উপর প্রোগ্রামিং এর কাজ শুরু করেন। এসবই তাঁর জীবনের উপর আত্মসমর্পনের ফল। বারবারা ডানকান নামের এক মহিলা যিনি কিছুদিন আগে ফ্লোড়িডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রোগ্রামিং নিয়ে স্নাতক উপাধি লাভ করেছেন, তিঁনি লেখকের সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই সিস্টেম প্লাস এর সভাপতি রিখ মেলহৃক স্বয়ং তাঁর অফিস এলেন এবং তাঁর তৈরি করা মেডিকেল ম্যানেজার সফটওয়্যার এর পরিবেশক হতে রাজি হলেন যা ছিলো এক অত্যন্ত চমৎকার ঘটনা। এছাড়াও তিঁনি কম্পিউটার দের ডিলার দের প্রদর্শনী তেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন।

অধ্যায় - ৬

স্বাভাবিক বৃদ্ধির শক্তি -

এরমধ্যেই সিস্টেম প্লাস এর সহায়তায় তাঁর প্রোগ্রামিং এর ব্যাবসায় প্রচুর সাফল্য এসেছে। তিঁনি মন বলতে যুক্তিবুদ্ধি সম্পর্ণ এক অবস্থার বাইরেও এক স্বজ্ঞালব্ধ মানসিক অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন যা সৃজনশীল কাজের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে থাকে। এইসময় ইলেকট্রনিক বিলিং সিস্টেম নিয়ে অসুবিধায় পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ল্যারি হর্টউইজ বলে একজন তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। জীবনের আর এক বিস্ময় ছিলো যে তার সাহায্যে ১৯৮০ সালে তাদের সফটওয়্যার সবচেয়ে বেশি ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে কাজ করেছিল প্রায় ২২ টি রাজ্যে। এমনকি ব্লু ক্রস ব্লু শিল্ড এর মতো প্রতিষ্ঠান ও মেডিকেল ম্যানেজার এর ব্যাবসায় অংশীদার হলো এবং প্রোগ্রামার এবং এক্সকিউটিভ হিসাবে মাইকেল সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গেলেন। রিক কার্ল, তাঁর এটর্নি ও ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক শিবিরের মানুষ। এরই মধ্যে পল ডবিনস, এক ল্যাবরেটরি

ইকুপমেন্ট কোম্পানির প্রতিনিধি এলেন যিনি নিজেও স্বামী যোগানন্দের ভক্ত। গ্রান্সভিলে এসে লেখকের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র দেখে এবং যোগানন্দের কিরিয়া যোগের অনুশীলন দেখে তিঁনি সেখানে থেকে যওয়ার ইচ্ছা করলেন এবং জীবনের অদ্ভুত প্রবাহে বেশ কিছুদিনের পর পল তাঁর পরিবার নিয়ে সেখানে চলে এলেন যেহেতু তাঁর কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছিলো। পল প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক সাহায্য করেছিলেন। একের পর এক অদ্ভুত ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে অধ্যায়টি শেষ হয়েছে। উইলবার এবং জুলিয়েট, তাঁর পাশের বাড়ির দম্পতিকে তিঁনি সুন্দর গাছ কাটা থেকে নিরস্ত করেন এবং বস্টোন এ এক খাবারের দোকানে তাঁর পুরোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা হয় যাকে তিঁনি যোগানন্দ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। তিঁনি বাবা মুক্তানন্দের অনুগামী হয়েছিলেন লেখকের পরামর্শে, যার ফলে তাঁর জীবন আজ অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। এরজন্য তিঁনি লেখককে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।

অধ্যায় -৭

অন্ধকার মেঘ থেকে রামধনু -

১৯৯০ সালে আরো একটি সম্পত্তি মন্দির ট্রাস্ট এর নামে কেনা হয়েছিল যার ফলে মন্দির এর আওতায় মোট সম্পত্তির পরিমান হলো ১৭০ একরস। এর ই মধ্যে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটি নৌকা এবং পিরামিড এর আকারের এক দারুন সুন্দর বাড়ি তিঁনি কিনলেন এবং সেখানে বাস করতে থাকলেন। এরই মধ্যে তাঁর ব্যাবসার জন্য প্রধান রাস্তার ধারে একটি জমি তৈরি করার প্রস্তাব দেন। তিঁনি জীবনের প্রবাহের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। যে ভদ্রলোক তাঁকে তার বাড়ি বিক্রি করেছেন তিঁনি আরো ৫০ একর জমি বিক্রির প্রস্তাব দিলেন ফোনে যা আবার প্রমান করলো ঘটনাপ্রবাহের কাছে আত্মসমর্পনের ফল।সেখানে কমিশনার এর তরফে এক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার স্থান হিসাবে নির্দিষ্ট হলেও লেখক এবং বাকি শহরের লোকজন মিলে তা প্রতিহত করেছিলেন। সেই ১৮৫ একর জমি তাঁরা ব্যাবসার কাজে লাগানোর অনুমতি পেয়েছিলেন যার সাহায্যে ১৪৫০০ এবং পরে তার দ্বিগুন ৮৫০০০ হাজার স্কয়ার ফিট এর এক বড়ো বিল্ডিং তৈরি করলেন প্রোগ্রামিং এর জন্য। এইসময় তিঁনি এক ম্যানেজার এবং একজন বিশেষজ্ঞ মানুষের প্রয়োজন অনুভব করলেন।সেইসময় টিম স্টেলি, একজন বিশেষজ্ঞ IT প্রশিক্ষক আবেদন করলেন কাজের জন্য। যদিও তিঁনি খ্রীষ্টান ছিলেন তিনি মন্দির ঘুরে দেখলেন এবং যোগ, ধ্যান - অনুশীলন নিয়ে নিজের মুগ্ধতা ব্যক্ত করলেন। এই সময় রাধা মন্দিরের অর্থনৈতিক কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এ ছাড়াও অমৃত এর তাঁর অনুগামীদের সাথে গন্ডগোল হওয়াতে তিঁনি লেখকের আশ্রমে আসেন এবং লেখক তাঁকে এক সুন্দর বাড়ি দেন বসবাসের। অমৃত সবসময় জীবনের সুগভীর এবং শক্তিশালী ঘটনাপ্রবাহের উপর নিজের জীবনের গতিপথকে পরিচালনা করেছিলেন তাই সেই কঠিন দিনগুলিতেও তাঁর কোনো ভাবান্তর হয় নি।জীবন আমাদের যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে তার মধ্য দিয়ে চলেছে। লেখকের আত্মসমর্পণ পরীক্ষা ইতিমধ্যে তাঁকে জীবনের রূপান্তরকারী শক্তিকে গভীরভাবে সম্মান করতে শিখিয়েছে। অমৃতের সাথে সেই সময়টি ভাগ করে নেওয়াটা জীবনের থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়।

অধ্যায় -৮

বিস্ফোরক সম্প্রসারনের আলিঙ্গন-

লেখক বুজেছিলেন নিজেকে জীবনের গতির কাছে মুক্ত করে দেওয়ার সাফল্য অথবা জীবনের এক বৃহৎ স্বাধীন স্বরূপের অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে। মেডিকেল ম্যানেজার এর বয়স প্রায় ১৫ বছর এবং প্রায় ৭৫ জন কর্মীকে নিয়ে এখন তাঁর প্রোগ্রামিং এর ব্যাবসা। ১৯৯৭ এ জন ক্যাঙ, কোম্পানির এক ডিলার, তিঁনি প্রস্তাব দিলেন তাঁর ব্যাক্তিগত প্রোগ্রামিং এর ব্যাবসা কে সিস্টেম প্লাস সহ আর ও কিছু পেশাদারী প্রোগ্রামিং এর সাথে মিশিয়ে দিতে। একজন এর ব্যাক্তিগত ইচ্ছা থেকে আজ প্রোগ্রামিং এক বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মেডিক্যাল ম্যানেজার কর্পোরেশন ‘ যা লেখক তৈরি করেছিলেন ১৫ বছর আগে। তিঁনি সেই কোম্পানির এক্সকিউটিভ, রিক এবং জন এবং সভাপতি এবং সম্পাদক নিযুক্ত হলেন। সদর অফিস হলো টাম্পা শহরে। এই প্রসঙ্গে তিঁনি তাঁর বাবার কথা উল্লেখ করেছেন যিনি একজন শেয়ার বাজারের কর্মচারী ছিলেন এবং মিকিকে তাঁর কোম্পানির সাফল্যের জন্য অনেক সাহায্য এবং উপদেশ দিতেন। একদিন লেখক ব্যাংকে গেলেন এবং প্রোগ্রামিং শুরুর সময় যে ডকুমেন্ট, সার্টিফিকেট এবং নতুন কেনা মন্দিরের জমির দলিল রেখেছিলেন তা সংগ্রহ করতে,যা ১৫ বছরের ইতিহাস বহন করেছিল, তা লেখককে আবেগপ্রবণ করেদিয়েছিল। একজন সিইও হিসাবে তিঁনি ঠিক করলেন প্রত্যেক সপ্তাহে তিঁনি বিভিন্ন স্থানের কোম্পানির অফিসারদের সাথে পর্যালোচনা বৈঠক করতেন। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য তিঁনি সাবিনা যাকে পল ভালোবেসেছিলেন তাকে নিযুক্ত করেছিলেন এবং সাবিনার পরিবারের মেডিক্যাল ম্যানেজার এর ডিলারশিপ এর এক ছোট্ট ব্যাবসা ছিলো ক্যালিফোরনিয়া তে। ইন্টারনেট কানেকশন এর মাধ্যমে মেডিক্যাল ম্যানেজার নেটওয়ার্ক কে আরো গতিবৃদ্ধির জন্য, যা লেখকের এক স্বপ্ন, তাঁর জন্য তিঁনি সাইনেটিক কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৭ মে ১৯৯৯ সালে সাইনেটিক কোম্পানির প্রধান মার্টি ওয়াইগড এর সাথে মেডিক্যাল ম্যানেজার একসাথে মিশে যায় এবং বাৎসরিক আয় হয়ে দাড়ায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার।এর ই মধ্যে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বি কোম্পানি হেলথদিওন এবং ওয়েবমেদ ভালোরকম সাফল্য পেয়েছিলো এনভয় নামের এক সবথেকে বড়ো ক্লিয়ারিংহাউস কিনে। ২০০০ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারী তাঁরা ওই দুটি কোম্পানি এর সাথে মেডিক্যাল ম্যানেজার এবং সাইনেটিক কে একসাথে সংযুক্ত করেছিলেন। এর ই মধ্যে তাঁর বন্ধু রায় কুর্যউইল তাকে আমন্ত্রণ জানালেন হোয়াটই হাউসে যিনি মেডিক্যাল ম্যানেজার এর সাথে কাজ করেছিলেন এবং প্রযুক্তিগত বিদায় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। স্মিথসন কোম্পানি যা ছিলো শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিগত কাজের পারদর্শী, তাঁদের সাথেও মেডিক্যাল ম্যানেজার চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। আমেরিকার সরকার এবং তাঁদের বিচার বিভাগ এই অনেকগুলি কোম্পানির সংযুক্তকরণের সব আইনি দিক খতিয়ে দেখার জন্য এক বৈঠক ডেকেছিলেন। সাবিনা এবং তিঁনি সব তথ্য পেশ করার পর, তাঁরা সব নিয়ম সঠিক বলে ঘোষণা করেছিলেন। লেখক আবার বুঝতে পারলেন জীবনের গতির কাছে নিজের আত্মমুক্তি ঘটালে এরকম প্রবল অভিজ্ঞতা সম্ভব।

অধ্যায় -৯

সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন-

৩ সেপ্টেম্বর,২০০৩ সালে পুলিস অপ্রত্যাশিতভাবে হানা দিয়েছিলো লেখকের অফিসে। লেখক গ্রান্সভিল শহরে গিয়েছিলেন এবং অফিসের কর্মচারী লিসা এলিয়ট এর ফোনে পেয়ে তিঁনি অফিসে ফিরে এলেন। তাঁকে একটি তালিকা দেওয়া হলো এবং তিঁনি বুঝতে পারলেন প্যাট সেডলক এবং ববি ডেভিস কোম্পানির অর্থপ্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ছিলো এবং এই অতর্কিত হানা এই ব্যাপার নিয়ে। লেখক তাঁর আধ্যাত্মিক শান্তির বাতাবরণে মন শান্ত করে বুঝতে পারলেন যেহেতু তিঁনি কোনো দোষ করেন নি, সেহেতু তাঁর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাঁর উচিত তদন্তকারী দের সাহায্য করা। এ সবই ববি ডেভিস এর ষড়যন্ত্র যাতে সে নিজে ছাড়া পেয়ে যায়। পরের দিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ বহু খবরের কাগজে এই রেইড এর কথা হেডলাইন্স হিসাবে প্রকাশিত হলো। লেখক ২ টি ফার্ম থেকে প্রায় ২০-৩০ জন উকিল নিযুক্ত করেছিলেন। এবং তাঁদের প্রধান হিসাবে জিম মার্শর লেখককে অনেক সাহায্য করেছিলেন। রান্ডি টার্ক, যিনি নিউ ইয়র্ক এর একজন বিখ্যাত অপরাধমূলক তদন্তের এবং বিখ্যাত আইনি সংস্থার উকিল ছিলেন তাঁকে মার্শর এর পরামর্শে লেখক এই ঘটনায় নিযুক্ত করলেন। তিঁনি তার সাথে নিউ ইয়র্কে প্রথম দেখা করেন। তিঁনি প্রায় ৩০ বছর ধরে এইরকম সরকারি অভিযোগ থেকে নির্দোষ মানুষজনদের সাহায্য করে আসছেন। তাঁদের আলোচনায় পরিষ্কার হলো যে ববি ডেভিস প্রায় ৬ মিলিয়ন ডলার অর্থ তছনছ করেছে এবং নিজেকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে কোম্পানির নামে সরকারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। রান্ডি তাঁর সহকারী হিসাবে জন সিমোন্স কে লেখকের সাথে পরিচয় করলেন। এর মধ্যে জানা গেলো সিইও হিসাবে লেখক হলেন সরকারের প্রধান সন্দেহভাজন ব্যাক্তি।। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে সরকার ডেভিড এর চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ১ বছরের কারাদণ্ড দিলো এবং জানা গেলো ববি এর প্রেমিকা যিনি মেডিক্যাল ম্যানেজার এর একাউন্টিং দপ্তরে কর্মরতা ছিলেন তিনিও ববি কে সাহায্য করেছেন এই অপরাধে। ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী তিঁনি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে ওয়েবমেড কোম্পানি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তিঁনি আবার সকালে ধ্যান - অনুশীলন সেরে নিজের পুরোনো ঘরে পুরোনো আসবাব এর সাথে একাত্ম হয়ে উঠলেন কেননা তিঁনি সবসময় সহজ জীবনযাপনে বিশ্বাস করতেন। এর ই মধ্যে তিঁনি লেখার কাজে মনোনিবেশ করলেন এবং তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তা - ভাবনা সম্পর্কিত সেই বিখ্যাত বই “The Untethered Soul” লিখতে শুরু করেন। এসব কিছুর পর ১৯ ডিসেম্বর,২০০৫ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করার নোটিশ এলো এবং সংবাদপত্রে আমেরিকা বনাম মিকি সিঙ্গার শিরোনামে খবর ছাপা হলো। লেখক বুঝতে পারলেন ডেভিড, লেখক এবং বাকিদের তাঁর সহযোগী অপরাধী হিসাবে অভিযোগপত্রে বর্ণিত করেছে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বেশ কিছুদিনের ধরে বিচারসভা চলেছিল। প্রায় ২ বছর কেটে গিয়েছে সেইসময় তিঁনি তাঁর নথি ফেরত পেলেন যা রেইড এর সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। কোম্পানি এবং উকিল রা সেসব নথি খতিয়ে দেখে বুঝতে পারলেন লেখক এবং তাঁর কোম্পানি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এইসম নিউ হারবিঙ্গার প্রকাশনী থেকে লেখকের পূর্বে বর্ণিত বই টি ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।

দীর্ঘদিন শুনানি চলার পর ২৭ মে, ২০১০ সালে কোর্ট এর রায়ে লেখক এবং কোম্পানি অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পেয়েছিলো। লেখক যেহেতু জীবনের গতির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন তাই শেষপর্যন্ত তিঁনি তাঁর স্বাধীনতা, অসীম শান্তি এবং ভালোবাসা নিয়ে জীবনযাপন করছেন তাঁর সেই চির পরিচিত মানবতার মন্দির এবং সুনিবিড় অরণ্যরাজীর মাঝে। লেখকের নিজের মতে জীবনের প্রবাহ তাঁকে অনেকাংশে নিজেকে মুক্ত করেছিল সামাজিক এবং বস্তুগত যন্ত্রনা এবং ব্যার্থতার গ্লানি থেকে।