THE POWER OF POSITIVE THINKING

……NORMAN VINCENT PEALE

নিজের উপর আস্থা রাখুন:-

নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিজের সামর্থের ওপর আস্থাবান হোন। বিনীত আচরণ মানব চরিত্রের এক দামি অলংকার। একান্ত আপনার যে শক্তি তার ওপর আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোনভাবেই সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করেই কেবল আপনি সাফল্য পেতে পারেন। হীনতাবোধ এবং প্রাচুর্যতা এসব আপনার বিশ্বাস লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, আত্ম-বিশ্বাস ও আত্ম-উপলব্ধি এসব আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলি ব্যক্তি জীবনে পূর্ণাঙ্গ সাফল্য লাভের মূল চাবিকাঠি। এই বইটি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হতে এবং আপনার মধ্যেকার নিহিত শক্তিকে চিনতে ও বুঝতে সাহায্য করবে।

চরম মানসিক পীড়া, যাকে বলা যেতে পারে হীনমন্যতাবোধ; তা যে কত মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তার সংখ্যা অগণ্য। একটি মানুষ জীবনে ব্যর্থ হওয়া মানেই জীবন্ত সমাহিত হওয়া। কিন্তু আপনার এমন কষ্ট ভোগ করার প্রয়োজন নেই। শুধু সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এমন অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তার জন্য আপনাকে যা করতে হবে, তাহল নিজের মধ্যে গঠনমূলক বিশ্বাসের ভীতি মজবুত করে তোলা।

হীনমন্যতার উৎসগুলো আমাদের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষের পথে শক্তিশালী বাধা স্থাপন করে থাকে। এটা হল, আমাদের শৈশব অবস্থায় কৃত একধরনের আবেগজনিত উৎপীরণ, অথবা কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ফল, অথবা এমন হতে পারে যে কিছুটা আমরা নিজেরাই করেছি। এইযে মানসিক পীড়া, এটা আমাদের ব্যক্তিত্বের কোনো অনুজ্জ্বল এবং অস্পষ্ট অতীতের কোনো অবস্থা থেকে দেখা দেয়। যেমন, যদি আপনার বড় ভাই স্কুলে প্রতিটি বিষয়ে A পান, এবং আপনি সব বিষয়ে শুধু C পান, তবে আপনি ধরেই নেন যে আপনার দ্বারা আর কিছু হবে না। দৃশ্যত: আপনি কখনো বুঝতে পারলেন না যে, এমনও বিষয় ঘটে যায় এবং ঘটে যাওয়ার সম্ভাব্য যে, একজন হয়তো স্কুলে বেশি নম্বর পেয়ে ভালো করতে পারেনি, কিন্তু স্কুলের বাইরে সে চরম সাফল্য লাভ করেছে। আর কর্মজীবনের সাফল্য লাভের মত উত্তম কিছু আছে কী? ছাত্র জীবনে বিফল হলেও কর্মজীবনে সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে না এমন ধারণা করা ঠিক নয়। কারণ সাফল্যের পথ নানাবিধ।

এই হীনমন্যতাবোধকে মন থেকে সরিয়ে দেবার জন্য দারুন এক উপায় আছে, তাহল সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি গভীর নিবিড় আত্মসন্দেহের ব্যাপার, যা মনকে গ্রাস করে আছে, তাকে বিশ্বাসের প্রাচুর্যে ভরে ফেলতে হবে। মনের ঠিক এমন এক পর্যায়ে বিধাতার উপর প্রচন্ড বিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলতে হবে, যা আপনার মধ্যে একটি বিনীত ভাব এনে দেবে, সাথে সাথে আপনার মধ্যে উত্তমরূপে এনে দেবে প্রকৃত বিশ্বাস।

আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি, উপলব্ধি এইসব নির্ভর করে আপনার ভাবনাটি কেমন তার উপর, যা প্রতিনিয়ত আপনার মনকে দখলে রাখছে। হেরে যাচ্ছেন, এমনটি যদি ভাবতে থাকেন, দেখবেন আপনি বাধ্য হয়ে হেরে যাওয়ার অনুভূতির কাছে দাসত্ব করছেন। কিন্তু আপনি যদি আত্মবিশ্বাসী ভাবনার অভ্যাস করেন এবং একে আপনার ভাবনার উপর আধিপত্য লাভ করতে দেন, দেখবেন সামর্থের এমন এক শক্তিশালী উপলব্ধি আপনার মধ্যে জেগে উঠেছে যে, আপনার জীবনে উদ্ভূত সমস্ত কষ্ট ক্লেশ আপনি জয় করতে সক্ষম হচ্ছেন। আত্মবিশ্বাসের উপলব্ধি আসলে নিজের মধ্যে ঘটে যাওয়া বর্ধিত শক্তি। আপনার ব্যক্তিগত শক্তি সম্বন্ধে যখনই কোনো নেতিবাচক চিন্তা আপনার মনে এসে উপস্থিত হবে, তখন ইচ্ছা করে একে বাতিল করে বা মন থেকে খসিয়ে দেবার জন্য আপনার যথার্থ চিন্তা শক্তিকে আদেশ করুন। আপনার কল্পনার পদে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে দেবেন না। তথাকথিত বাধাগুলোকে মূল্যহীন জ্ঞান করুন, ওসবের একেবারেই দাম নেই, এমনটা ভাবুন। কষ্ট ক্লেশগুলো নিয়ে অবশ্যই বোঝাপড়া করতে হবে আবার ওগুলোকে মন থেকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য খুব দক্ষতার সাথে সব ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেকে বিধাতার হাতে সমর্পণ করুন। এটা করতে সহজ ভাবে বলুন:"আমি বিধাতার কাছে সমর্পিত"। তারপর বিশ্বাস করুন, এখন আপনি আপনার প্রয়োজনীয় শক্তি বিধাতার কাছ থেকে গ্রহণ করছেন। অনুভব করুন যে এটা আপনার মধ্যে চলছে, নিশ্চিতভাবে ভাবুন যে,সৃষ্টিকর্তার রাজত্ব আপনার মধ্যে বিরাজমান, আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন যে এই অবস্থায় আপনার জীবনের চাহিদাগুলো পূরণ হবার জন্য ওই ঐশ্বীশক্তি আপনার মধ্যে পর্যাপ্ত শক্তিরূপে কাজ করছে। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিধাতা আপনার সাথে এবং কোনো কিছুই আপনাকে হারিয়ে দিতে পারেনা। মনে প্রাণে বিশ্বাস করুন যে, আপনি এখন বিধাতার কাছ থেকে শক্তি পাচ্ছেন।

শান্তিপূর্ণ মন শক্তি উৎপাদন করে:-

মনে পুরোপুরি শান্তি পাবার জন্য প্রাথমিকভাবে একটি পদ্ধতি অনুশীলন করতে হয়, তাহলো, মনকে একেবারে শূন্য করে ফেলা। মন পরিষ্কার করার ব্যাপারটি হল, মন থেকে ভয়ভীতি, ঘৃণাবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, দুঃখ-সন্তাপ এবং দোষীভাবার হীনতাসমূহ বিদূরিত করার অভ্যাস করা। কারণ এইসব যদি মনকে সবসময় দখল করে রাখে তবে সেই মনের কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আপনি সচেতন ভাবে এমন চেষ্টা করুন যাতে আপনার মনটা পরিষ্কার হয় এবং শান্তিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ মন উন্নীত করার ক্ষেত্রে একটি ফলপ্রসূ কৌশল হল, প্রতিদিন নীরবতা পালনের অভ্যাস করা। প্রতি ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত ১৫ মিনিট সবাইকে যেকোনো রকম চেষ্টায় পুরোপুরি চুপচাপ থাকার অভ্যাস করা উচিত। আপনার চেনা জানা সবচেয়ে নীরব একটি জায়গায় আপনি চলে যান এবং সেখানে বসে অথবা শুয়ে থেকে ১৫ মিনিট চুপচাপ থাকার কৌশল অভ্যাস করুন। কারো সাথে কথা বলবেন না, কিছু লিখবেনও না, কিছু পড়বেনও না। মনকে নিরপেক্ষ থাকতে দিন। এটা করা প্রথমে হয়তো সহজ হবে না, কারণ নানা চিন্তাভাবনা আপনার মনকে নাড়া দেবে, কিন্তু অভ্যাসের মধ্য দিয়ে আপনার দক্ষতা বাড়বে। টমাচ কার্লাইল বলেছেন,"নীরবতা হল এমন এক উপাদান যাতে মহৎ মহৎ অনেক রীতি ও আদর্শ গঠিত হয়।"

প্রার্থনার শক্তি পরীক্ষা করে দেখুন:-

প্রার্থনার শক্তি হল মানসিক শক্তির প্রকাশ স্বরূপ। ঠিক যেমন বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আণবিক শক্তির প্রকাশ ঘটায়। ঠিক তেমনিভাবে বৈজ্ঞানিক কার্যপ্রণালীও আধ্যাত্মিক শক্তি নির্গত করে থাকে এবং তা হয় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। উদ্দামশীল শক্তির উদ্দীপনাময় উপস্থাপনী এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। কোনো এক বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ বলেন, প্রার্থনা হল এক মহানতম শক্তি যা ব্যক্তি বিশেষে তার ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে যথাযথভাবে কাজে লাগায়। যদি এই শক্তি সম্বন্ধে আপনার অভিজ্ঞতা না হয়ে থাকে তবে সম্ভবত আপনাকে প্রার্থনা করার নতুন কৌশল রপ্ত করতে হবে। একটি দক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রার্থনা সম্বন্ধে পড়াশোনা করা ভালো।

এ বিষয়টি অনুধাবন করা খুবই জরুরী যে, আপনি যখন প্রার্থনা করছেন তখন জগতে সবচেয়ে বিস্ময়কর শক্তি পরিচালনা করছেন। নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে আজকাল আধ্যাত্মিক প্রতিভার জাগরণ দেখা যাচ্ছে। যারা একাধিক ক্রমে নতুন নতুন এবং যথার্থ আধ্যাত্মিক কলাকৌশল গুলো আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। বিষয়টি উপদেশ যোগ্য যে, ওইসব আধ্যাত্মিক দ্রষ্টাদের উদ্ভাবিত পথ অবলম্বন করে আপনিও প্রার্থনার শক্তি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখুন যাতে প্রার্থনা শক্তি সবল ও কার্যকরী প্রমাণিত হয়। যদি প্রার্থনার এই প্রায়োগিক বিষয়টি নতুন এবং নিশ্চিত বলশক্তি আপনাকে দিতে পারে এবং তা আশ্চর্য রূপে বৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণিত হয় তবে মনে রাখবেন প্রার্থনার গুপ্ত শক্তি সবচেয়ে ফলপ্রসূভাবে আপনার বিনীত এবং উন্মুক্ত মনকে বিধাতামুখী করে তুলবে। যেকোনো পন্থাই হোক না কেন আপনি যদি ঐশী শক্তিকে নাড়া দিতে সক্ষম হন এবং তা আপনার মনে একটি ঐশী শক্তি প্রবাহ বয়ে দিতে পারে তবে সেই পন্থাই হবে বৈধ এবং ব্যবস্থার যোগ্য একটি পন্থা।

মনের আকাঙ্খাকে প্রার্থনায় পরিণত করতে হলে প্রতিদিনের প্রার্থনা পদ্ধতি হতে হবে সৃজনশীল প্রার্থনা। সৃজনশীল প্রার্থনার উদ্ভাবিত একটি বিষয় হল মনের পর্দায় ছবি অঙ্কিত করা। পদার্থবিদ্যার মূল কারণটি হল 'শক্তি'। মনোবিজ্ঞানের মূল কারণটি হল কোনো কিছু বাস্তবায়িত করার জন্য সফল ইচ্ছা শক্তি। যেমন যে লোকটি কোনো বিষয়ে সাফল্য লাভের প্রবল ঝোঁক মনে মনে ধারণ করে সে সাফল্য পেয়েই যায়, আবার কেউ যদি সাফল্য না পাবার মতো কমজোর ভাবে কোনো বিষয়ে মনে মনে ধারণ করে, তবে তার পক্ষে সাফল্য পাবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই সাফল্য লাভ বা অসাফল্য লাভের বিষয়টি সেভাবেই ঘটে যে যেমন ভাবে অর্থাৎ যে যেমন বলিষ্ঠভাবে বা দুর্বল ভাবে তার মনে মনে ছবিটি অংকন করে।

মূল্যবান কিছু ঘটবে এমন বিষয়ে আশ্বস্ত হতে প্রথমে এ বিষয়ে প্রার্থনা করুন এবং তা যাচাই করে দেখুন যে, বিধাতার দৃষ্টিতে তা পূরণযোগ্য কিনা, তারপর আপনি বিষয়টি আপনার মনের পর্দায় অঙ্কিত করুন যেন তা ঘটে এবং আপনার সচেতন মনে ছবিটি নিবিড় ভাবে ধরে রাখুন। বিধাতার ইচ্ছার কাছে সেই ছবিটি ক্রমাগত সমর্পণ করতে থাকুন, লেখক বলতে চেয়েছেন বিষয়টি বিধাতার হাতে ছেড়ে দিন। দেখুন তিনি আপনাকে কি দিক নির্দেশনা দেন তা অনুসরণ করুন, বুদ্ধিমানের মতো কঠোর পরিশ্রম করুন এবং এভাবে আপনার যা করনীয় তা করে সাফল্যকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসুন। কাজটি করুন এবং আপনি অবাক হয়ে যাবেন যে কি অদ্ভুত ভাবে আপনার সযত্নে রক্ষিত মনের ছবিটি বাস্তবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে পরিণত হবার মতো যে মূল ইচ্ছা আপনি পোষন করেছিলেন এবং তার জন্য আপনি প্রার্থনা পরিচালনা করেছেন, মনের ভাবনায় ছবি এঁকেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন, তা কিন্তু সম্ভব হয়েছে বিধাতার শক্তি এর ওপর বর্ষিত হবার মধ্য দিয়ে, যা আপনি প্রার্থনা করেছিলেন। লেখক ব্যক্তিগতভাবে এই পদ্ধতি অনুশীলন করে দেখেছেন যে, এর মধ্যে কত বড় শক্তি নিহিত রয়েছে। এবং এই বিষয়টি অন্যদের অনুশীলন করার জন্য পরামর্শও দিয়েছেন। এবং তারাও ঠিক একইভাবে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন যে, প্রার্থনার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা এর মধ্য থেকে সৃজনশীল শক্তি নির্গত হতে দেখেছেন। আপনিও কিছু নিয়মের মাধ্যমে প্রার্থনা শক্তির প্রয়োগ করে কার্যকরী ফল পেতে পারেন:-

(১) প্রতিদিন অন্তত কয়েক মিনিট সবকিছু থেকে বিরত থাকুন। কোনো কথা বলবেন না। ওই সময়টুকু শুধু মহান সৃষ্টিকর্তার কথা ভাবতে অভ্যাস করুন। আপনার মনকে আধ্যাত্বিকভাবে ধারণক্ষম করে তুলবে।

(২) সহজ, স্বাভাবিক শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে মৌখিকভাবে প্রার্থনা করুন। মনে যা আছে সব বিধাতাকে বলুন। একেবারে অপরিবর্তনীয় পবিত্র শব্দাবলী ব্যবহার করতে হবে তা অবশ্যই ভাববেন না।

(৩) প্রতিদিনের নির্ধারিত কাজে যাবার সময়, পথে চলার সময়, বাসে চলার সময় অথবা যখন আপনি আপনার ডেস্কে বসে আছেন তখন আপনি প্রার্থনা করুন। অল্প কিছুক্ষণের জন্য মনকে বিধাতার উপস্থিতি উপলব্ধির জন্য কেন্দ্রীভূত করে রাখুন এবং এক মিনিটের প্রার্থনাকে কাজে লাগান।

(৪) যখন আপনি প্রার্থনা করেন তখন শুধু চাওয়া ঠিক হবে না, কিন্তু তার বদলে আপনি নিশ্চিত হন যে বিধাতা আপনাকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন, প্রার্থনার বেশিরভাগ সময় ব্যায় করুন বিধাতাকে ধন্যবাদ দিয়ে।

(৫) প্রার্থনা করার সময় প্রার্থনা পূর্ণ নাও হতে পারে এমন ভাবনা মনের স্থান দেবেন না। শুধুমাত্র প্রার্থনা পূর্ণ হবে এই ভাবনাই মনে স্থান দেবেন কারণ তা নিশ্চিত ফলদায়ক।

(৬) সব সময় বিধাতার ইচ্ছা মেনে নেবার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান করুন। আপনি যা চান তার কাছে চান, কিন্তু বিধাতা যাই আপনাকে দেন স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করুন। আপনার চাওয়ার চেয়ে এমন পাওয়াটা অবশ্যই ভালো।

(৭) যাদের আপনি পছন্দ করেন না তাদের জন্য অথবা যারা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন। বিদ্বেষ হলো আধ্যাত্বিক শক্তির সর্ব প্রধান অন্তরায়।

(৮) যাদের জন্য প্রার্থনা করবেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করুন। অন্যদের জন্য আপনি যত প্রার্থনা করবেন বিশেষ করে যাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই সেই অধিক প্রার্থনার সুফল আপনার প্রতি ফিরে আসবে।

ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের শক্তি:-

সমস্যা সমাধানের আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি হলো, বিধাতাকে আপন সমস্যায় অংশীদার হিসেবে ধারণ করা। বাইবেল এবং অন্যান্য শাস্ত্রেও বর্ণিত অনেক ধারনার মধ্যে একটি হলো যে, বিধাতা আমাদের সাথে বিরাজমান। প্রায় সকল ধর্মে এমন শিক্ষা দেয় যে, মানুষের সমস্ত ভোগান্তির সময়, তাদের সমস্যায় এবং জীবনের সার্বিক পরিস্থিতিতে বিধাতা আমাদের কাছে কাছেই থাকেন। আমরা তার সাথে কথা বলতে পারি, তার ওপর নির্ভর করতে পারি, তার কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারি এবং অপরিমিত লাভজনক কিছুও তার ইচ্ছার কাছ থেকে আমরা পেতে পারি, পেতে পারি তার সহযোগিতা। বাস্তবিকভাবে সবাই সাধারণত এটাই বিশ্বাস করে যে, বিষয়টা সত্যি এবং অনেকেই এই সত্যের বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

আপনার সমস্যায় সঠিক সমাধান পেতে হলে আপনার বিশ্বাসের চেয়ে একধাপ সামনে এগোতে হবে কারণ, একজন যখন এই বিশ্বাস প্রক্রিয়াটি নিয়ে যাচাই করতে চায়, তখন তাকে এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে যে, এখন বিধাতা স্বয়ং উপস্থিত। বিশ্বাস শক্তি নিয়ে এমন অনুশীলন করতে হবে যে, অনুভবের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারবেন আপনার পাশে যেমন আপনার স্ত্রী বাস্তব অবস্থান করছেন, অথবা আপনার ব্যবসার অংশীদার বা আপনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু যেমন আপনার সাথে রয়েছেন, ঠিক তেমনি ভাবে বিধাতাও রয়েছেন। তার সাথে কথা বলতে অভ্যাস করুন; বিশ্বাস করুন যে, তিনি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছেন এবং আপনার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছেন। অনুমান করুন যে তিনি আপনার মনকে চেতনার মাধ্যমে প্রভাবিত করছেন, যাতে আপনার ধারনাগুলো এবং প্রয়োজনীয় অন্তর্দৃষ্টির বিষয় সমূহ সমস্যা সমাধানে কার্যকরী হয়। সুনিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করুন যে, সমস্যা সমাধানের এই পদ্ধতিতে কোন ভুল হবে না, বরঞ্চ আপনার অভিপ্রেত কাজে আপনি সঠিকভাবে পরিচালিত হবেন, যার ফল দাঁড়াবে সম্পূর্ণ সঠিক।

ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে প্রথমত আপনার নিজের ভেতরে যে শক্তি রয়েছে তা সম্যকভাবে বুঝতে হবে। দ্বিতীয়তঃ, একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া জরুরী। ব্যক্তিগত সমস্যা সাফল্যজনকভাবে সমাধান করতে গিয়ে অনেকেই যে ব্যর্থ হয় তার পেছনে নিশ্চিত কারন হল, তাদের আধ্যাত্মিক এবং আবেগ জনিত ভোতা ভাবটি।

দিনের পর দিন বেঁচে থাকার জন্য জীবনের যে স্বাভাবিক পরিচালনা আমরা করি, সেখানে এই জরুরি ক্ষমতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কিন্তু অনন্য সাধারণ পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তি যদি প্রয়োজন মনে করেন তবে তিনি এই বাড়তি শক্তিকে প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তলব করতে পারেন। একজন ব্যক্তি যিনি তার কাজ করার বিশ্বাসকে উন্নীত করতে পারেন তবে তিনি তার শক্তিকে সুপ্ত থাকতে দেন না, কিন্তু তার বিশ্বাস অনুপাতে সাধারণ কাজের সাথে সম্পর্কিত সকল অবস্থায় সেই সুস্থ ক্ষমতার অনেকখানি তিনি কাজে লাগাতে পারেন।

কিছু বাস্তব উপদেশ অনুসরণ করুন:

(১) আপনি যখন অসুস্থ তখন আপনি যেমন আপনার ডাক্তারকে ডাকেন, ঠিক তেমনি আপনার ধর্মগুরুকেও ডেকে আনুন। অন্যভাবে বলতে গেলে চিকিৎসার সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শক্তি যে আরোগ্য কমায় সমান গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, এ কথা বিশ্বাস করুন।

(২) আপনি যাই করুন না কেন কোনোভাবেই আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না অথবা ভয় পাবেন না। কারণ যদি ভয় ভীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তাহলে আপনার মনে নেতিবাচক চিন্তাই আসবে এবং সে কারণে আপনার প্রীতিভাজন কারো যখন ইতিবাচক এবং আরোগ্যকর চিন্তন প্রয়োজন তাকে সাহায্য করার জন্য, তখন দেখা যাবে তার দিকে ধ্বংসকারী চিন্তাই ধেয়ে আসছে।

(৩) সব সময় স্মরণ রাখবেন যে, বিধাতা বিধি বিধান বহির্ভূত কিছু করেন না। আরো স্মরণ রাখবেন যে, আমাদের পার্থিব আইন কানুন শুধুমাত্র বিরাট শক্তির খন্ড খন্ড প্রকাশ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা প্রবাহিত হচ্ছে। আধ্যাত্বিক বিধান অসুস্থতার ওপর আধিপত্য করে। বিধাতা সব রকম অসুস্থতার জন্য দুটো প্রতিকারের ব্যবস্থা রেখেছেন। একটি হলো, বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রয়োগযোগ্য প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে আরোগ্য সাধন এবং অপরটি হল, বিশ্বাসের দ্বারা প্রয়োগযোগ্য আধ্যাত্বিক বিধান অনুসারে আরোগ্য লাভ।

(৪) আপনার প্রীতিভাজনকে সম্পূর্ণরূপে বিধাতার হাতে সমর্পণ করুন। আপনার বিশ্বাসের শক্তিবলে তাকে আপনি ঐশ্বি-শক্তি ধারায় ব্যস্ত করতে পারেন। সেখানে আছে নিরাময়, কিন্তু তা কার্যকরী করার জন্য রোগীকে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে বিধাতা ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেবেন।

(৫) আপনার প্রীতি ভাজনের একটি ছবি মনের পর্দায় এঁকে ফেলুন, যেন সে ভালো অবস্থায় আছে। মনস চক্ষুতে দেখুন যেন সে চমৎকার স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছে। মনে মনে তাকে এমন ভাবে চিত্রায়িত করুন যেন সে ভালোবাসায় এবং ঐশী গুণাবলীতে সমুজ্জ্বল। সচেতন মন হয়তো অসুস্থতার ইঙ্গিত করতে পারে এমনকি মৃত্যুর সংকেতও দিতে পারে। কিন্তু আপনার মনের দশ ভাগের নয় ভাগ অবচেতন অবস্থায় বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য চিত্রটি অবচেতন মনে নিমজ্জিত করুন এবং মনের এই শক্তিশালী অংশটুকুই উজ্জ্বল স্বাস্থ্য এবং শক্তি বয়ে আনবে।

(৬) যথাযথই স্বাভাবিক হন। বিধাতার কাছে প্রার্থনা করুন যেন তিনি আপনার প্রীতিভাজনকে রোগমুক্ত করেন। অর্থাৎ আপনি যা সর্বান্তকরণী চান তার জন্য বিধাতার কাছে অনুরোধ করুন যেন তিনি তা পূরণ করেন।

সহজ শক্তির লাভের জন্য শিথিল হোন:-

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরাতে অসংখ্য আমেরিকাবাসি ঘুমাবার জন্য যে ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করেন তার পরিমাণ ৬ মিলিয়নেরও বেশি অর্থাৎ ৬০ লক্ষের উপর। এই আতঙ্কজনক বক্তব্যটি কয়েক বছর আগে লেখক জেনেছেন এক ড্রাগ উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের এক সভায়।কী এক করুন অবস্থা। ঘুম হলো এক বলকারক প্রাকৃতিক পদ্ধতি। একজন ভাবতেই পারেন যে সারাদিন কাজ করার পর সে শান্তিতে ঘুমাবে কিন্তু দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে যে ঘুমাবার মতো কৌশলটি আমেরিকানরা হারিয়ে ফেলেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে এমন এক একজন রোগী ভর্তি হয়েছে যে কোনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত নয় বা তার কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে অথবা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোনো কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এর পেছনের কারণটা হলো, তারা তাদের আবেগকে সুসংহত করতে এবং সুশৃংখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দেহ-মনের নানান সমস্যায় ভুগছে, বিশেষ করে তাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বহুলাংশে তাদের মানসিক অবস্থার কারণে। ক্লিনিক এর কাজে বারবার একটি সমস্যাই দেখা দেয়, তাহলো দুশ্চিন্তা। এর সংখ্যা এবং পরিমাণ এতই বেশি যে একে আমেরিকাবাসির এক প্রচলিত দৈহিক ও মানসিক ভোগান্তি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র আমেরিকা বাসিরাই যে শুধু দুশ্চিন্তায় ভোগে তাই নয়।দুশ্চিন্তা কমানোর একটি বিশেষ এবং সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে মনোভাবের উপর হালকা মাত্রার ডোজ প্রয়োগের অভ্যাস করা। সবকিছু আরেকটু ধীর গতিতে সম্পন্ন করুন, অতি উত্তেজনাকে পাস কাটিয়ে চলুন, একেবারে চাপের মধ্যে না থেকে।

মনকে শান্ত রাখুন। তাড়াহুড়ো জনিত প্রতিক্রিয়ার কারণে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে তাকে এড়িয়ে চলুন এবং শান্তি দিতে পারে এমন চিন্তা করতে অভ্যাস করুন। এমন সুরভিত একটি অবস্থা ধরে রাখার কৌশলটি হল, মেজাজকে সংযত রাখা এবং আপনার শক্তিকে সুসংহত রেখে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য এর প্রয়োজনীয় তাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে যে, সহজ শিথিল শক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আপনি নিজেকে দক্ষতা পূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবে গড়ে নিতে পারেন এমন দু একটি কাজের পরিকল্পনা করুন।

মনের নিষ্কাশন ক্রিয়া প্রয়োগ করুন। প্রত্যেকদিন কয়েকবার মন থেকে সব উত্তেজনা, সমস্ত বিদ্বেষ, হতাশা, নৈরাশ্য, বিরক্তি ইত্যাদি সবকিছু বের করে দিন। যদি বারবার এবং নিয়মিত মন থেকে এসব বের করে না দেন তাহলে এসব অসুস্থকর চিন্তাগুলি জমা হতে হতে এমন এক বিশ্রী অবস্থা সৃষ্টি করবে যে, শেষ পর্যন্ত একটি বিরাট বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। মনে সহজ শিথিল ভাবে শক্তি সঞ্চয়ের পথে যে উপাদান গুলো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সেগুলোকে নিয়মিত বের করে দিয়ে মনকে নির্ঝঞ্ঝাট রাখুন।

আর একটি পর্যায়ে করণীয় হল, আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা করুন। আধ্যাত্মিক চিন্তার অর্থ হলো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রতিটি বিরতির সময় মনকে পরিবর্তিত রাখা। সারাদিনই অন্তত তিনবার চোখ খুলে পাহাড়ের দিকে তাকান। তাতে বিধাতার সাথে আপনি ঐকতানে বাধা হয়ে থাকবেন। এতে আপনার অন্তর শান্তিতে ভরে থাকবে। কিভাবে কঠিন কাজ সহজে করা যায় তার উপর পরীক্ষিত এই পদ্ধতি গুলো যাচাই করে দেখুন। এগুলো আপনাকে সহজ শিথিল হতে এবং সহজ শক্তি পেতে সাহায্য করবে।

(১) এরকম ধারণা করবেন না যে, আপনি দানবের মতোই প্রকাণ্ড পৃথিবীটাকে নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন। অত্যাধিক চাপের মধ্যে থাকবেন না নিজেকে খুব গুরুত্বের সাথে নেবেন না।

(২) নিশ্চিত হন যে আপনি যে কাজ করছেন তা আপনার মনের মত। তাতে কাজটি আপনার জন্য আনন্দ বয়ে আনবে, একগুঁয়ে অনুভূতি নয়। সম্ভবত আপনার কাজটি পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। যদি করতেই হয় তবে নিজেকে পরিবর্তন করুন, তাতে আপনার কাজটি অন্যরকম লাগবে।

(৩) প্রথমে কাজের পরিকল্পনা করুন তারপর পরিকল্পনাকে কাজে লাগান। পদ্ধতির অভাব বোধ থেকেই 'আমি বিপদাপন্ন' এমন অনুভূতি আসে।

(৪) তড়িঘড়ি করে কোন কিছু করতে চেষ্টা করবেন না।

(৫) সঠিক মানসিক অবস্থায় আসুন। মনে রাখবেন যে আপনার কাজের স্বাচ্ছন্দ অথবা কাঠিন্য নির্ভর করে যে আপনি কিভাবে তা ভাবছেন। যদি ভাবেন কাজটি কঠিন তবে আপনি তা কঠিনই করে ফেলছেন। যদি ভাবেন কাজটি সহজ তবে তা সহজ সমাধানের পথেই যাবে।

(৬) সহজ শিথিল থাকতে অনুশীলন করুন। সব সময় সহজেই সবকিছু করুন। চাপ প্রয়োগ কিংবা জোর খাটাবেন না। আপনার চলনের সাথে একে খাপ খাইয়ে নিন।

(৭) আপনার কাজের জন্য প্রার্থনা করুন। কারণ এর মধ্য দিয়ে আপনি কাজটি করার জন্য সহজ দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন।

(৮) আজ যা করতে পারেন তা কালকের জন্য ফেলে রাখবেন না এবং এর জন্য নিজেকে সুশৃংখল করে তুলুন। অসমাপ্ত কাজ জড়ো হতে হতে দেখবেন আপনার কাজকে কঠিন করে তুলছে। সময় মত সব কাজ সম্পন্ন করুন।

(৯) সেই মহান অদৃশ্য অংশীদার কে (ঈশ্বরকে) আপনার সাথে আছে বলে অনুভব করুন। এটা ভাবতে বিস্ময়কর মনে হয় যে, তিনি আপনার ভার নিজের হাতে তুলে নেবেন। বিধাতা যেমন উপাসনালয়ে থাকেন কিন্তু একইভাবে তিনি আপনার বাড়িতে, অফিসে, কলকারখানায়, স্টোরে এবং রান্নাঘরেও থাকেন। আপনার কাজ সম্পর্কে আপনি যতটা জানেন তার চেয়ে বেশি জানেন বিধাতা।

আকস্মিক ক্রোধ এবং বিরক্তি থেকে বিরত হোন:-

অনেকেই তাদের জীবনকে অযথাই ক্ষমতা এবং শক্তির অপব্যবহারের দ্বারা ক্রোধ এবং বিরক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কঠিন করে তোলে। আপনি কী কখনো ক্রোধ বা বিরক্তি প্রকাশ করেন? কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনিও তেমন কিছু করেন কিনা।

প্রথম পদক্ষেপে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, আপনার গতিবেগ কমাতে হবে অথবা গতিবেগের হার কিছু কিছু করে কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা সঠিক বুঝতে পারি না যে আমাদের জীবনের গতিশীলতা কতটা বুদ্ধি লাভ করেছে অথবা ঠিক কতটা গতিতে আমরা আমাদের জীবনকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছি। অনেকেই এই ঊর্ধ্বগতির প্রাবল্যে শারীরিক স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে ফেলছে কিন্তু তার চেয়েও দুঃখজনক হলো যে, এই করতে গিয়ে তারা তাদের মনকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে এবং আত্মাকেও ফালিফালি করে ফেলছে। অথচ একজন মানুষের পক্ষে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ শান্তি বজায় রেখে এবং আবেগগত দিক থেকে উচ্চ গতিশীলতা বজায় রেখেও চলা সম্ভব।আমাদের চরিত্রই নির্ধারণ করে যে আমাদের জীবন ও মনের গতিবেগ কেমন হওয়া উচিত। মন যখন একটি সন্তপ্ত মনোভাব থেকে আরেকটি সন্তপ্ত মনোভাবের দিকে বিশৃংখলভাবে ভেঙে যায়, তখন এই সন্তপ্ত অবস্থার ফলশ্রুতি হিসেবে খিটখিটে মনোভাবের সৃষ্টি হয়। আধুনিক জীবনে যে দ্রুতগতি মানুষের জীবনে অবধারিত হয়ে পড়েছে একে অবশ্যই হ্রাস করা প্রয়োজন। যদি না আমরা এর যে অত্যধিক উত্তেজনাকর অবস্থার কারণ থেকে উদ্ভূত দুর্বলকারী অবস্থার তিক্ততাকে গভীরভাবে ভোগ করতে না চাই। অত্যধিক উত্তেজনা মানুষের শরীরে বিষাক্ততা উৎপাদন করে এবং এর থেকে তৈরি হয় আবেগজনিত পীড়া। আর এমনিভাবে আসে অবশ্যন্যতা এবং নৈরাশ্যকর মনোভাব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সেসব বিষয়ে আমরা যদি ক্রোধান্বিত এবং বিরক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করি তাহলে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে নানা রকম কষ্ট নেমে আসে এবং তা জাতীয় এবং জাগতিক জীবনে প্রভাব সৃষ্টি করে।

আধ্যাত্বিক শান্তি বজায় রাখা অসম্ভব যদি জীবনের গতিবেগ সন্তপ্ত অবস্থাতেই বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিধাতা ঠিক এই গতিকে সমর্থন করবেন না। তিনি আপনার গতির সাথে সমতা রক্ষা করে চলবেন না। বস্তুত তিনি বলেন "যদি তুমি এমন বাতুলতা পূর্ণ গতিতে সম্মুখ বাড়তে চাও বাড়, কিন্তু যখন তুমি শান্ত হয়ে পড়বে আমি তখন তোমাকে নিরাময় করব"। বিধাতা চলেন উত্তেজিত বা ক্ষুব্ধ না হয়ে, ধীর এবং যথাযথ সংগঠিত অবস্থায়। আর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বিজ্ঞপ্তির হার হল বিধাতা প্রদত্ত গতির হার। যা কিছু করেন তা করা হয় সঠিকভাবে এবং ওসব তিনি তাড়াহুড়ো করে করেন না। তার না আছে আকস্মিক ক্রোধ না আছে উত্তেজনা। তিনি শান্তিপূর্ণ এবং সেই কারণেই তিনি দক্ষ।

বিস্মিত হবার মতো একটি বিষয় হলো যে, বর্তমান যুগে লোকেরা মানসিক চাপা উত্তেজনার সাথে খুব একটা অভ্যস্ত। যে কারণে তারা একটা অসুখী এবং আরামহীন জীবন কাটাচ্ছে শান্তির অভাবে। মনের চাপা উত্তেজনা কমাবার জন্য যে উত্তেজনা মনে হয় সর্বত্র আমাদের মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, আপনি স্বয়ং আপনার গতিবেগ কমিয়ে সেই চাপা উত্তেজনা কমানোর কাজ শুরু করতে পারেন। তা করতে আপনাকে যা করতে হবে তা হল, গতি নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে চলুন, শান্ত হন। আকস্মিকভাবে ক্রদ্ধ হয়ে যাবেন না, বিরক্ত হবেন না। শান্তিপূর্ণ ভাব বজায় রাখতে অনুশীলন করুন। অনুশীলন করুন বিধাতা প্রদত্ত শান্তি, যা আপনাকে দিয়ে থাকে ধীশক্তি। তারপর মনোযোগ দেন শান্ত শক্তিবোধের দিকে, যা আপনার মধ্যে পারদর্শী হয়ে উঠবে।

আপনি কি কখনো আপনার মাংসপেশিতে, আপনার শরীরের সংযোগস্থলে ঐশী শান্তির কথা একটুও ভেবে দেখেছেন? সম্ভবত যদি আপনার শরীরে জোড়ায় জোড়ায় ঐশী শান্তি অবস্থান করে তবে সেই জায়গাগুলোতে ব্যথা বেদনা অনুভূত হবে না। আরাম কেদারায় অথবা বিছানায় শিথিল ভাবে বিশ্রাম নিন, মাথা থেকে পা পর্যন্ত যত পেশি আছে প্রত্যেকটির কথা ভাবুন এবং প্রতিটি পেশিকে বলুন, "ঐশী শান্তি তোমাকে স্পর্শ করছে।" তারপর অনুভব করতে থাকুন যে, আপনার সারা শরীরের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রবাহিত হচ্ছে। নির্দিষ্ট এই কার্যধারার মধ্য দিয়ে আপনার পেশি এবং সংযোগস্থল গুলো যত্ন পাবে।

শান্ত ভাব নিয়ন্ত্রণের বিকাশ সাধনের জন্য শান্তভাবে চিন্তা করা আবশ্যক কারণ চিন্তার ধরনটি সবসময় সমবেদনশীল ভাবে শরীরের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং মনের মধ্যে আনাগোনা করে। আর এও সত্যি যে শরীরকে প্রথমে শান্ত করতে পারলে মনকেও শান্ত করা সম্ভব। বলা যেতে পারে যে, শারীরিক ভাবভঙ্গি আকাঙ্ক্ষিত মানসিক ভাবের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ছয়টি বিষয় নিয়ে গঠিত একটি সুন্দর কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হওয়ার মাত্রা কমিয়ে ফেলতে পারেন–

(১)আরাম কেদারায় শিথিল ভাবে বসুন। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে চেয়ারে সমর্পণ করে দিন। পায়ের আঙুলের ডগা থেকে আরম্ভ করে একেবারেই মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত শরীরের সমস্ত অংশে শিথিল ভাব ধারণ করুন। এ কথাগুলো বলে শিথিল ভাব নিশ্চিত করুন: "আমার আঙ্গুলের ডগা এখন সহজ শিথিল, আমার হাতের আঙ্গুল আমার মুখাবয়েবের পেশি সবই এখন শিথিল।"

(২) নিজের মনের কথা এমন ভাবে চিন্তা করুন তা যেন ঝড়ের সময়কার হ্রদের পানির উপরিভাগের মত, ঢেউ ভেতরে আন্দোলিত এবং ভীষণ বিশৃঙ্খল কিন্তু এখন ঢেউগুলো তিতিয়ে পড়েছে এবং হ্রদের বেশিরভাগ এখন শান্ত এবং অসংক্ষুব্ধ।

(৩) আপনার দেখা সবচেয়ে সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ দৃশ্যাবলী নিয়ে দুই বা তিন মিনিট ভাবুন, উদাহরণ স্বরূপ পর্বতের আড়ালে সূর্যাস্তের দৃশ্য বা নিস্তব্ধতায় পূর্ণ ভোরের গভীর উপত্যকার কথা অথবা মধ্যাহ্নের বনরাজীর কথা অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের উপর ঝলমলে চাঁদের আলোর কথা, এসব নিয়ে স্মৃতিচারণ করুন।

(৪) ধীরে ধীরে বারবার শান্তভাবে প্রত্যেকবার সুন্দর সুরের সাথে পরপর কতগুলি বিশেষ শব্দমালা, যেগুলো নিস্তব্ধতা শান্তি প্রকাশ করে যেমন, প্রশান্তি-এই শব্দটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এবং শান্তিপূর্ণ মন নিয়ে বলতে থাকুন। স্থৈর্য, নিস্তব্ধতা এই ধরনের আরও যেসব শব্দ আছে সেগুলো আপনি বারবার উচ্চারণ করতে থাকুন।

(৫) আপনার জীবনে মানসিকভাবে মুক্ত থাকার সময়ের একটি তালিকা তৈরি করুন, যখন বিধাতার সযত্ন সেবা আপনি আপনার বিশেষ চেতনা শক্তির দ্বারা বুঝতে পারেন এবং স্মরণ করুন কিভাবে আপনি বিরক্ত বোধ করেছিলেন এবং উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। আর এমন অবস্থায় কেমন করে তিনি আপনার মধ্য থেকে সমস্যাকে বের করে এনে আপনার যত্ন নিয়েছেন। তারপর আপনি জোরে জোরে পুরাতন গীতির লাইনটি উচ্চারণ করুন, দীর্ঘকাল তোমার শক্তি আমাকে রক্ষা করেছে। এও নিশ্চিত যে সেই শক্তি এখন আমাকে পরিচালিত করছে।

(৬) নিচে উল্লেখিত কথাগুলো বারবার বলুন, এই কথাগুলোর এমন বিস্ময়কর শক্তি আছে যা আপনার মনকে সহজ, শিথিল এবং শান্ত করে তুলতে পারে। তাকেই তুমি রাখবে নিশ্চিত শান্তিতে যার মন তোমাতে সুস্থির। দিনে কয়েকবার এই কথাগুলো উচ্চারণ করুন, যে মুহূর্তে সুযোগ পান সেই মুহূর্তে এ কথাগুলো স্মরণ করুন। সম্ভব হলে বেশ জোরে জোরেই বলুন, সুতরাং দিনের শেষে দেখা যাবে কথাগুলো আপনি অনেকবার বলে ফেলেছেন। এই কথাগুলোকে এমন বিশ্বাস নিয়ে কল্পনা করুন যেন এগুলো কার্যকর সূক্ষ্ম পথে মনে প্রবেশ করার মতো মূল বিষয়বস্তু, চিন্তাশক্তির আনাচে কানাচে পৌছাবার মতো আরোগ্যকর ওষুধের মতো। এ হলো মানসিক চাপ থেকে আপনাকে মুক্ত করার সুবিদিত ওষুধ।

যখন আপনি পরামর্শ অনুযায়ী এই অধ্যায়ে প্রদত্ত কৌশলগুলো নিয়ে বাস্তব প্রয়োগের কাজ শুরু করবেন দেখবেন আপনার ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। ক্রমোন্নতির সরাসরি আনুপাতিক হার অনুসারে যে শক্তি আপনার মধ্য থেকে বের করে নেয়া হয়েছিল সেই অসুখকর অভ্যাস এর দ্বারা আপনি এখন অনুভব করতে পারবেন যে, জীবনের দায়দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালনের জন্য আপনার সামর্থ্য কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিভাবে মানুষের ভালোবাসা আপনি পাবেন:-

আমরা স্বীকার করি যে, আমরা চাই মানুষ আমাদের ভালোবাসুক। ভালো হবার জন্য, শক্তিশালী হবার জন্য, সুন্দর মানুষে পরিণত হবার জন্য যাদেরকে আপনি সাহায্য করুন না কেন তারা শেষ পর্যন্ত আপনার অনুরক্ত ভক্তে পরিণত হবে। কাজেই যত বেশি সংখ্যক সম্ভব সবাইকে গড়ে তুলুন। কাজটি করবেন নিঃস্বার্থভাবে। কাজটি করুন কারণ আপনি তাদের ভালোবাসেন এবং তাদের মধ্যে আপনি সম্ভাবনা দেখতে পান। কাজটি করুন তাতে কোনদিন আপনার বন্ধুর কোনো অভাব হবে না। আপনার সম্পর্কে সবার ধারণা থাকবে সুন্দর। মানুষকে গড়ে তুলুন এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসুন। ভালো করুন এবং দেখবেন তাদের শ্রদ্ধা এবং স্নেহ ভালোবাসা আবার আপনার দিকে ঘুরে আসছে।

মানুষ আপনাকে ভালবাসবে তার মূল নীতি হিসেবে আপনার দীর্ঘায়িত এবং কষ্টার্জিত জোরের কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ এইসব খুবই সাধারণ এবং সহজেই তাদের সত্যকে ব্যাখ্যা করে।

(১) স্বাচ্ছন্দ্যবোধের মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলুন, যাতে আপনার মধ্যে শ্রান্তি কোনো আশ্রয় না পায়। একটি পুরনো জুতার মতো, পুরনো টুপির মত হন।

(২) স্বচ্ছন্দ গতিতে চলতে পারেন এমন গুনাবলি অর্জন করুন, যাতে কোনো কিছু আপনাকে বিরক্ত করতে না পারে।

(৩) অহমবোধে আক্রান্ত হবেন না। কোন কিছু জানেন সে বিষয়ে আপনার অনুভূতি প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন। কিন্তু স্বাভাবিক থাকুন এবং সাধারণ বিনয় ভাব বজায় রাখুন।

(৪) অপরের কাছে নিজেকে আগ্রহভাজন করে তুলুন, যাতে মানুষ আপনার সঙ্গ চায়, আপনার সঙ্গে পেয়ে আগ্রহজনক কোনো মূল্যবান কিছু লাভ করে।

(৫) আপনার ব্যক্তিত্ব থেকে আঁচর কাটা অংশটুকু বের করে দিতে শিখুন, এমনকি ওসবও যেসব অবচেতন মনে আপনি করে ফেলতে পারেন।

(৬) আন্তরিকভাবে কাউকে আরোগ্য করার চেষ্টা করুন, একজন ধর্মপ্রাণ সৎ মানুষ হিসেবে তা করুন। সব ভুল বুঝাবুঝি যা আগে ছিল এবং এখনো আছে তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আপনার অযথা অভিযোগ সমূহ মন থেকে বের করে দিন।

(৭) আন্তরিকভাবে মানুষকে ভালবাসতে না শেখা পর্যন্ত তার অনুশীলন চালিয়ে যান।

(৮) কেউ সাফল্যজনক কিছু করলে তাকে স্বাগত জানাবার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করবেন না, অথবা দুঃখের সাথে আপনার সহানুভূতি অথবা নৈরাশ্য প্রকাশ করুন।

(৯) গভীর আধ্যাত্বিক অভিজ্ঞতা লাভ করুন, যাতে মানুষকে আপনি কিছু দিতে পারেন এবং তার মাধ্যমে মানুষ শক্তিশালী হতে পারে এবং আরো কার্যকর ভাবে জীবনকে মোকাবিলা করতে পারবে।।মানুষকে শক্তি দিন এবং তারা আপনাকে স্নেহ ভালোবাসা দেবে।

সমাপ্ত

(উপরিউক্ত অংশটি NORMAN VINCENT PEALE -র লেখা "THE POWER OF POSITIVE THINKING "-এর সারসংক্ষেপ। আপনি চাইলে পুরো বইটি পড়তে পারেন)।

ধন্যবাদ