MOTHER TERESA

MEG GREENE

পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে প্রতিটি জীব সাধারণত নিজের জন্যই চিন্তা করে ও নিজের জন্য বেঁচে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যায়, এই কথাটি আমাদের মানব সমাজে জন্ম নেয়া প্রত্যেকের জন্যই প্রযোজ্য। সাধারণভাবে আমরা নিজেদের সুখ,শান্তি ও বিলাসিতার চিন্তায় কাজ করি ও নিজেদের নিয়েই সুখী থাকতে ভালোবাসি। অপরের দুঃখ- কষ্ট খুব কম মানুষের মনেই বেদনার জন্ম দেয়। আর তার থেকেও কম মানুষ রয়েছেন এই পৃথিবীতে, যারা নিজেদের সময় ও উপার্জন অন্যের জন্য ব্যয় করেন। মাদার টেরেসা ছিলেন এমনই একজন জনদরদী ও সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব, যিনি তার মানব জীবনের সমস্তটাই দান করেছেন গরীব,দুঃখী, দুস্থ, অনাথ মানুষের কল্যাণে। নিপীড়ন, স্বশাসন ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য যে সকল মহাত্মা নিজেদের সারাটা জীবন অতিবাহিত করেছেন মাদার টেরেজা তাদের মধ্যে অন্যতম।

মেগ গ্রীনের লেখা জীবনী মূলক গ্রন্থ "মাদারটেরেজা"উপস্থাপিত করা হলো।

পূর্বে আলবেনিয়ার একটি অঞ্চল মেসিডোনিয়া তে অবস্থিত স্কোপজে শহরটি বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে ছিল হৈচৈ পূর্ণ এক ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। সমসাময়িক শহরগুলির মতো না হলেও স্কোপজের জনসংখ্যা ২৫০০০ এর কাছাকাছি ছিল শতাব্দীর শুরুতে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে দারদানিয়ানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম বলকান উপদ্বীপের ইলিনা থেকে আগত আধুনিক সময়ের আলবেনিয়ানদের আদি বংশধরেরা, যারা প্রাচীন গ্রিসের উত্তর অংশে বাস করত, স্কুপি নামে পরিচিত ছিল। পরে এই শহর রোমানিয়ানদের নিয়ন্ত্রনে আসে। ষষ্ঠ শতকের দিকে এই অঞ্চল বেরেঘেজিটি নামক দাসদের অধীনে চলে আসে।এরাই এই শহরের বর্তমান নামকরণ করে।

৯ এর দশকে বাইজান টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে বহু আলবেনিয় গ্রীস এবং এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়। কিছু শতাব্দীর পর আলবেনিয়া এক নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তুর্কিরা বলকান উপদ্বীপ সংযুক্ত করার জন্য তাদের সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকে, যা অটোমান সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। ১৩৮৮ সালে আলবেনিয়া আক্রমণ করে অটোমান তুর্কিরা ১৫ শতকে সমগ্র সাম্রাজ্য নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। তুর্কিরা অঞ্চল দখল করতে পারলেও আলবেনিয় মানুষের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাতে সক্ষম হয়নি। ১৪৪৩ সালে স্কেন্ডারবেগ নামে পরিচিত আলবেনিয়ানদের একজন,আলবেনিয়ান রাজকুমারদের নিয়ে এক সমাবেশ করেছিলেন এবং তুর্কিদের তাড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে স্কেন্ডারবেগ এক পর্বতের দুর্গ হতে তুর্কীদের বারবার প্রতিহত করে গেছেন। তার এই সাহসী যুদ্ধ সেই সময়কার এক বিখ্যাত পরাক্রমশালী শক্তির বিরুদ্ধে কেবলমাত্র সম্মানিত হয়নি, সামরিক এবং আর্থিক দিক থেকে নেপলস সাম্রাজ্য,পেপেসি, ভেনিস, এবং সিসিলি উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে বসবাসকারী রাগুসা নামক জনজাতির থেকে সাহায্য মিলেছিল। ১৪৬৮ সালের স্কেনডারবেগের মৃত্যুর পর আলবেনিয়দের প্রতিরোধ হ্রাস পেতে থাকে এবং পুনরায় ১৫০৬ সালে তুর্কীদের সুযোগ করে দেয় অঞ্চলটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার। তবে স্কেন্ডারবেগ এর এই প্রতিরোধ আলবেনিয়ান সংগতিকে কেবলমাত্র শক্তিশালী করেনি, এর অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে জাতীয় পরিচয় এবং চলমান সংগ্রামী অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে, যা জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে।

তুর্কিরা আলবেনীয়দের উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার লাভে সফল হল ইতালিতে নবজাগরণ শুরুর প্রাক্কালে। ফলস্বরূপ আলবেনিয়দের কাছে কোন রকম সুযোগ ছিল না নবজাগরণ এ অংশগ্রহণ করার এবং উপকৃত হওয়ার। নবজাগরণ মানুষের কৃতিত্ব পর্যালোচনা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধিতে জোর দেয়। বলকানরা কেবলমাত্র নবজাগরণ হতে বঞ্চিত হয়নি,তুর্কি আধিপত্য আরবীয়দের জীবনে এক বিশাল ধ্বংসাত্মক এবং দুর্দশা নিয়ে আসে,যা তাদের অর্থনৈতিক জীবনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এই নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে জনসাধারণের এক চতুর্থ অংশ ইতালির দক্ষিণ অংশ, সিসিলি এবং ডালমেশিয়ান দ্বীপের উত্তর অংশে পালিয়ে যায়। অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, যা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের পরিচয়।

আলবেনিয়াতে স্বাধীনতা অর্জনের সমস্ত চেষ্টা দমন করতে খ্রিস্টীয় প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তুর্কিরা তাদের ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করতে একটি প্রথা উদ্ভাবন করে।সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ আলবেনিয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।অপর পক্ষে যারা প্রথমে ধর্মান্তরিত হয়েছিল,তারা ইসলাম ধর্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, কেবলমাত্র খ্রিস্টানদের প্রতি শোষণ এবং হিংস্রতার বলি থেকে বাঁচতে। যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃত হয়েছিল, ফলস্বরূপ তাদের এক পাহাড় প্রমাণ কর প্রদান করতে হতো, যা থেকে কেবলমাত্র মুসলিমদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।এই ধর্মীয় বিভাজনের অবশিষ্টাংশ টিকে ছিল ১৯ শতক পর্যন্ত,যখন আলবেনীয় জাতীয় নেতারা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

১৯ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে। 'ইউরোপের দুর্বল মানুষ' নামে অভিহিত তুর্কিরা নিজেদের আধিপত্য রক্ষার ক্ষেত্রে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করে। বর্তমান আধিপত্য থেকে মুক্তির সম্ভাবনা আঁচ করে আলবেনিয় নেতারা বলকান দের সহায়তায় পুনরায় স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে থাকে। ১৮৭৮ সালে আলবেনিয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা কসোভোর একটি শহর প্রিজরেন এ সাক্ষাৎ করেন এবং 'আলবেনিয়ান লিগ অফ প্রিজরেন' গঠন করেন। এই লীগের মূলত দুটি লক্ষ্য ছিল প্রথম আলবেনিয় এলাকা কসোভো, স্কোড্রা,মনাসটির এবং জানিনা- এই চারটি এলাকাকে একত্র করা, যা তুর্কিরা চারটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিল। প্রাথমিকভাবে দ্য লিগ অফ প্রিজরেন কেবলমাত্র আলবেনিয়ার স্বাধীনতা পুনরায় ফিরে চায়নি, অটোমান সাম্রাজ্যের অন্দরে একটি স্বাধীন আলবেনিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ আলবেনিয়ান জাতীয়তাবাদ, ভাষা,সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিক্ষা প্রভৃতি স্বতন্ত্রভাবে প্রচারের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু ১৮৮১ সালে তুর্কিরা এই লিগকে দমন করে। যদিও লিগের জাতীয়তাবাদী চেতনা বেঁচে ছিল, যার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আলবেনিয়ান নেতারা ১৯০৮ সালে মনাস্টির শহরে মিলিত হয়ে একটি জাতীয় বর্ণমালা গ্রহণের পদক্ষেপ নেন। বর্ণমালাটি বেশিরভাগ লাতিনের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।এ ছাড়াও গ্রীক, আরবি প্রভৃতি এই বর্ণমালায় ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।

দমনপীড়নের পাশাপাশি তুর্কি প্রশাসন আলবেনিয়দের ক্ষমতা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কি নামে একদল তরুণ আধুনিকীকরণ এবং ক্ষমতার বৃদ্ধির নামে আলবেনিয়ান দের সাথে করা পূর্ব প্রতিশ্রুতি অমান্য করে। এর ফলে আলবেনিয়রা হতাশ হয়ে পুনরায় অস্ত্র গ্রহণ করে এবং ১৯১২ সালে তুর্কিদের বাধ্য করে আলবেনিয়াকে স্বাধীনতা প্রদানের কাছাকাছি নিয়ে যেতে।এই ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া আলবেনিয়ার প্রতিবেশী বলকানরা যারা ইতিমধ্যে ওই অঞ্চলটি ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিল,তুরস্কের বিরুদ্ধে ১৯১২ সালে অক্টোবরে যুদ্ধ ঘোষণা করে।যুদ্ধের ফলস্বরপ আগত বিনাশ রোধ করার জন্য আলবেনিয়ান প্রতিনিধি দল ভ্লোর এ সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯১২ সালের ২৮ শে নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আলবেনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এই জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতের আবহে জন্ম গ্রহণ করেছিল এক শিশু,যে একদিন সব সংঘাত অতিক্রম করে বলেছিল "পৃথিবী ঈশ্বরের দান এবং আমাদের কর্তব্য জাতির উদ্দেশ্যে সেবা করা।"

নিকোলা বোজাক্সহিউ ছিলেন স্কোপজের জাতীয়তাবাদীদের একজন স্বাধীন বিল্ডিং ঠিকাদার এবং খাবারের পাইকারি আমদানি কারক। তিনি ছিলেন এক বিশাল প্রভাবশালী এবং সমৃদ্ধ পরিবারের সন্তান। নিকোলা প্রিজরেণ থেকে স্কোপজেতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন কারণ ধীরে ধীরে শহরটি বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। নিকোলা এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ ছিলেন। খুব দ্রুততার সাথে স্কোপজেতে একটি বাড়ি এবং আরো কিছু সম্পত্তি কিনে নিয়েছিলেন। তিনি শহরের নামী ডাক্তারদের ওষুধ সরবরাহ করতেন।এরপর এক ইটালিয়ান ব্যবসায়ীর সাথে অংশীদারিত্ব শুরু করেছিলেন, যার তেল, চিনি, পোশাক এবং চামড়ার ব্যবসা ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে নিকোলা ছিলেন এক প্রকৃত ব্যবসায়ী, যিনি কিনা পাঁচটি ভাষায় সাবলীল ছিলেন এবং আফ্রিকার উত্তর ও পূর্ব অংশে ভ্রমণ করেছিলেন ইউরোপের পাশাপাশি। এছাড়াও তিনি সক্রিয়ভাবে লোকাল রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি, টাউন কাউন্সিলে কাজ করা এবং তার ফার্মের সাথে চুক্তি করে স্কোপজেতে প্রথম সিনেমা থিয়েটার নির্মাণ করা হয়। শিল্প অনুরাগী হওয়ার সাথে তিনি স্থানীয় এক রোমান ক্যাথলিক চার্চের সদস্য ছিলেন। এই সময় নিকোলা বিবাহ করেন ড্রানাফাইল বার্নাই কে। নব দম্পতি শীঘ্রই স্কোপজেতে তাদের বিশাল সুসজ্জিত বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।বাড়ির সাথে বড় বাগান ছিল। ড্রানা তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।১৯০৪ সালে প্রথম কন্যা সন্তান আগা, ১৯০৭ সালে পুত্র লাজার এবং ১৯১০ সালে ২৬শে আগস্ট দ্বিতীয় কন্যা সন্তান এবং শেষ সন্তান অ্যাগনেস গনশা কে জন্ম দেন। একদিন পর ২৬ শে আগস্ট অ্যাগনেস কে যার অর্থ আলবেনিয় ভাষায় "ফুলের কুঁড়ি", খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হলো।

কিশোরী বয়স থেকেই গনশা নিজের শৈশব নিয়ে কেবলমাত্র একটি কথাই বলতেন যে এটি ছিল সুন্দর। একমাত্র তার দাদা লাজার শৈশব কে বর্ণনা করত "ভয়-ভীতিহীন,মুক্ত এবং শান্তির"। যদিও নিকোলা সন্তানদের যথেষ্ট অনুশাসনে মানুষ করেছিলেন। প্রত্যেকটি সন্তান পিতার আগমনের অপেক্ষা করত এবং তিনি প্রায় সস্তার ঘর সাজানোর জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন। নিকোলা খুব ভালো গল্প বলতে পারতেন। তিনি নিজের জীবনে যাত্রা পথে হওয়া অভিজ্ঞতার কথা সুন্দরভাবে সন্তানদের সামনে পরিবেশন করতেন।সর্বদা বোজাক্সহিউ পরিবার জনকোলাহলে গমগম করত এবং বহু মানুষ ব্যবসা অথবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে আসতেন।

ড্রানা ছিলেন একজন আদ্যোপান্ত ঘরোয়া মহিলা, যিনি সর্বদা স্বামী সন্তানদের নিয়ে থাকতেন।সারাদিন তিনি খাবার বানানো,ঘরদোর পরিস্কার এবং জামাকাপড় পরিষ্কার নিয়ে থাকতেন।নিকোলা বাড়ি ফিরলেই সমস্ত কাজ বন্ধ করে একটি পরিষ্কার জামা পড়ে এবং সন্তানদের তৈরি করে তাদের পিতাকে অভিবেদন জানাতেন। স্বামীর মত ড্রানা নিজেও ছিলেন বহু কাছে পারদর্শী এবং তার ধৈর্য কম ছিল। একটি ঘটনা বলেছিলেন গনশা,যা তার মায়ের এই ভাবমূর্তির পরিচয় দেয়। কোন এক সন্ধ্যায় বাচ্চারা বসে বকবক করছিল। তিনি প্রথমে শুনলেন কিন্তু কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর তিনি বাইরে বেরিয়ে বিদ্যুতের প্রধান সুইচ বন্ধ করে দেন। অ্যাগনেস বলেছিলেন যে তিনি বাজে বকবক করা বা বাজে আলোচনা করার জন্য বিদ্যুৎ অপচয় করতে অপারগ। এই ভাবে ড্রানা তার ছোট মেয়ে গনশার মননে অহেতুক সময় এবং শব্দ নষ্ট না করার বীজ বপন করে দেন।

অ্যাগনেস ছিলেন তার মায়ের অনুরূপ। ড্রানার মত অ্যাগনেস এর ছিল ডিম্বাকৃতি মুখ, স্বতন্ত্র নাক এবং দাদা লাজারের মতে- অ্যাগনেস ছিলেন মমতাময়ী এবং সর্বদা অন্যকে সাহায্য করতেন, যা তাকে মাঝেমধ্যেই বিপদে ফেলেছে। একবার অ্যাগনেস লাজারকে আলমারি থেকে জ্যাম এবং মিষ্টি চুরি করতে সাহায্য করেছিলেন, যা ড্রানা কখনোই অনুমোদন করেননি।

নিকোলা প্রত্যেকটি সন্তানের মনেই ছোট থেকে দুটি ধারণা গেঁথে দিয়েছিলেন, একটি বিশ্বাস এবং অপরটি পিতৃ ভূমি। এই আদর্শ তাদের চিন্তা ভাবনায় গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল এবং শৈশবকে শক্তিশালী করেছিল। শক্তিশালী অ্যালবেনিয়ান জনগণের কাছে তাদের পিতা ছিলেন গর্ব এবং তাদের নিত্য জীবনযাত্রার ধ্রুবক। লাজারের একটি কথা মনে পড়ে -তার পিতা বোনেদের বলেছিলেন তারা যেন কখনোই ভুলে না যায় তারা কার সন্তান এবং কোন পটভূমি থেকে এসেছে।নিকোলা নিজের বাড়িটি রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আগে স্বাধীনতার জন্য অর্থ দান করতেন।১৯১২ সালের ২৮শে নভেম্বর অ্যাগনেস যখন ২বছরের, বোজাক্সহিউ পরিবারে একটি খুশির দিন ছিল। এই দিন আলবেনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং বাকি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে নিকোলা আনন্দে নৃত্য এবং নানান খেলায় অংশগ্রহণ করেন।

নিকোলা নিজের সন্তানদের মধ্যে এক জাতীয়তাবাদী গর্ব এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ড্রানা সন্তানদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা বসার ঘরে মিলিত হয়ে সান্ধ্য সংগীত পরিবেশন করত। ড্রানা কেবলমাত্র সন্তানদের ধর্ম সম্পর্কে পাঠদান করতেন না, ইহা তাদের দৈনন্দিন অভ্যাস করতে সাহায্য করেছিলেন। আলবেনিয়াতে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় ছিল ছোট। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০%। সংখ্যায় কম হলেও স্কোপজে এবং রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ আলবেনিয়া জুড়ে ছিল ঘনিষ্ঠভাবে।

ড্রানা কেবলমাত্র এই ধর্মীয় অনুশাসন গুলি মেনে চলতেন না, তিনি গভীরভাবে এই কাজের মহত্ব বিশ্বাস করতেন। তিনি সর্বদা দরিদ্রদের সাহায্য করতেন, এই কাজে তার স্বামী এবং সন্তানেরা সর্বদা তাকে সমর্থন এবং সাহায্য করতেন। নিকোলা প্রতিদিন কিছু টাকা ড্রানা কে দিতেন অভাবীদের দান করতে এবং প্রায় দিনই সেইসব বুভুক্ষু মানুষ গুলো পরিবারের সাথে খাবার খাওয়ার সুযোগ পেত। ড্রানা সন্তানদের সর্বদা বলতেন এই অসহায় মানুষগুলি আমাদের পরিবারের অংশ।লাজারের সুখ স্মৃতির মধ্যে একটি হলো যে- একবার ড্রানা এক টিউমার রোগীকে নিজ হাতে সেবা সুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। প্রায় ড্রানা গরিব মানুষগুলির বাড়িতে খাবার, পোশাক, ওষুধ পত্র নিয়ে যেতেন এবং অ্যাগনেস তার সঙ্গী হতেন। আধ্যাত্মিকতা অ্যাগনেস কে তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল এবং তার আধ্যাত্মিক জীবনকে দিশা প্রদান করেছিল।

বাচ্চারা বড় হওয়ার সাথে প্রথম চার বছর আলবেনিয় ভাষা শেখার পাশাপাশি সেক্রেট হার্ট চার্চে যেতে শুরু করল। পাঁচ বছরের মাথায় তারা সার্বিয়ান এবং ক্রোয়েশিয়ান ভাষা শেখে। চার্চ স্কুল ছাড়ার পর তারা পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয় এবং অ্যাগনেস নিজেকে এক ভদ্র, মার্জিত ছাত্রী হিসেবে প্রমাণ করে।

স্বাধীনতার পরেও নিকোলা রাজনীতির কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। ১৯১৯ সালে যখন আলবেনিয় নেতারা কসোভো উদ্ধারের চেষ্টা চালান, নিকোলা যুগোস্লভিয়ার বেলগ্রেডে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দিতে যান। সমাবেশ চলাকালীন নিকোলা অসুস্থ বোধ করলে, ড্রানা অ্যাগনেসকে এক পুরোহিত ডাকতে পাঠান। ভাগ্যের সহায়তায় এক পুরোহিত পেয়েও যান অ্যাগনেস। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী নিকোলার শরীরে প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হলে, তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিকোলা মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।ডাক্তার এবং পরিবারের সদস্যরা মনে করেন- রাজনৈতিক শত্রুতা থেকে তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়, কিন্তু এটার কোন জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এক রাতের মধ্যে পরিবারের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। নিকোলার মৃত্যুর পর তার ব্যবসায়িক সঙ্গী পুরো ব্যবসা আত্মসাৎ করেন। ড্রানার কাছে যথেষ্ট টাকা এবং প্রমাণের অভাবে কিছুই করার থাকে না। কেবলমাত্র বাড়িটি রক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি। নিকোলার মৃত্যু ড্রানাকে গভীরভাবে বিধ্বস্ত করে। এই অবস্থায় বাড়ির বড় সন্তান আগার ওপর সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে। কয়েক মাস পর ড্রানা শোক সামলে ওঠেন এবং ভাবতে থাকেন কিভাবে তার স্বামীর হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের প্রতিপালন করবেন।

শীঘ্রই ড্রানা মানসিক আঘাত কাটিয়ে পুনরায় নিজের লক্ষ্যে ফিরে আসেন। সংসার চালানোর জন্য তিনি ছোটখাটো এমব্রয়েডারির কাজের পাশাপাশি পোশাক এবং কার্পেট তৈরি শুরু করেন। লাজার তাকে পোশাক তৈরির কোম্পানিতে সাহায্য করতে থাকে।এভাবেই আস্তে আস্তে পরিবারের আর্থিক দিক থেকে সচ্ছলতা আসে এবং পুনরায় দরিদ্রদের জন্য তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। সপ্তাহে একদিন অন্তত নিজের ব্যস্ত কর্মসূচির বাইরে তিনি দরিদ্রদের বাড়ি যেতেন। বহু অসহায় মানুষ যারা নিজেদের পরিবার হতে বঞ্চিত,কেউ মদে আসক্ত,সবাইয়ের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। এইভাবে ড্রানা নিজের সন্তানদের সাহায্যের গুরুত্ব বোঝাতেন। তিনি বলতেন বিনা স্বার্থে মানুষকে সাহায্য করো। ঈশ্বর তোমার সাথে আছেন। ড্রানা সব সময় নিত্যনতুন পন্থার মধ্য দিয়ে নিজের সন্তানদের জীবন সম্পর্কে মূল্যবোধ শেখাতেন।একবার এক ঝুড়ি ভর্তি আপেলের মধ্যে এক খারাপ আপেল রেখে দিলেন।পরের দিন সকালে সন্তানদের আদেশ করলেন ঝুড়িটি খুলে দেখতে। স্বাভাবিকভাবে ভালো আপেল গুলো পচে গেছে।তিনি সন্তানদের বললেন যে "কেবলমাত্র একটি বস্তু বা একটি খারাপ মানুষ সবাইকে দুর্নীতিগ্রস্ত করতে যথেষ্ট।" তিনি সর্বদা এই সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের থেকে সন্তানদের দূরে থাকতে বলতেন এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে বলতেন। ড্রানা সন্তানদের আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি নৈতিক বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন।

নিকোলার মৃত্যুর পর সন্তানদের ওপর ড্রানার প্রভাব ছিল গভীর। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সর্বদা সন্তানদের সাথে সময় কাটাতেন। সক্রিয় ভাবে সন্তানেরা স্থানীয় চার্চের বহু কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখতো। স্থানীয় সেক্রেট হার্ট চার্চ এর প্রভাব ছোট্ট কিশোরী অ্যাগনেসের উপরে ছিল বিস্তর। মাত্র ১২ বছর বয়সে অ্যাগনেস একজন সন্ন্যাসিনী হওয়ার ইচ্ছা প্রথম প্রকাশ করেন। চার্চটি কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে না, এটি আলবেনিয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। তিন সন্তানের মধ্যে অ্যাগনেস সবথেকে বেশি আধ্যাত্মিকতার দিকে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সারাটা জীবন মাদার টেরেসা আধ্যাত্মিকতার রহস্য গোপন রেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় তার ১২ বছরের জীবনে কখনো তিনি কোন সন্ন্যাসিনী দেখেননি। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস তাকে এই ধর্মীয় জীবনের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তিন সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সব থেকে রুগ্ন। ছোট থেকেই তিনি নানারকম শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতেন। শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্বেও পরবর্তী ছ বছর তিনি তার পড়াশোনার পাশাপাশি চার্চের কাজ গুলিতে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন এবং কিছু সময়ের জন্য নান হওয়ার ইচ্ছা কে বিরতি দেন।১৯২৫ সালে ফাদার জামব্রেকোভিচ নামে এক তরুণ জেসুইট পুরোহিত চার্চে এসেছিলেন। ফাদারের আদর্শ অ্যাগনেস কে বিশেষ রকম ভাবে প্রভাবিত করে এবং ফাদার একটি লাইব্রেরী প্রবর্তন করেন, যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অ্যাগনেস পড়াশোনা করতেন। ফাদার কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের জন্য 'সোডালিটি অফ চিল্ড্রেন' নামে একটি ক্যাথলিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে অ্যাগনেস সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠন তরুন তরুনীদের জন্য নানারকম পার্টি থেকে শুরু করে জীবনধারণের,খেলাধুলার সমস্ত কিছু আয়োজন করত। ১৯২৪ সালে ফাদার ঘোষণা করলেন যুগোস্লাভিয়ার একটি জেসুইট দল ভারতবর্ষের বাংলায় যাচ্ছে দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত মানুষগুলোকে সাহায্যার্থে। তিনি বহু চিঠি পড়ে শোনালেন জেসুইট দের,যেখানে বাংলার এই দুর্ভিক্ষ মানুষগুলির অসহায় অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এরই মধ্যে এক ধর্ম প্রচারক চার্চে আসেন এবং জেসুইটদের এসব কর্মকান্ডের কথা আলোচনা করার পাশাপাশি অনুদানের আবেদন করেন। অ্যাগনেস ছোট বাচ্চাদের বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে শিক্ষাদান করে। ফাদারের আগমন অ্যাগনেস এর মনে এই ধর্মীয় দায়িত্ব র প্রতি বিশেষ প্রভাব ফেলে এবং সে তার এক বোনের কাছে অর্থ সাহায্য চায়, যে কিনা ম্যান্ডেলিন বাজিয়ে অর্থ সংগ্রহ করত। চার্চের কাজের পাশাপাশি শিশু দের শিক্ষাদান করতে থাকেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে আফ্রিকার পীড়িত মানুষগুলির জন্য তিনি কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

১৯২০ র দশকে তিনি তার বয়সের তুলনায় পরিণত হয়ে ওঠেন। ভালো ছাত্রী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন শৃঙ্খলাবদ্ধ। বন্ধু মহলে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন অপরকে সাহায্য করার জন্য। তিনি কাজ করার পাশাপাশি একাধারে লেখিকা ছিলেন। কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। সর্বদা তার সাথে একটি নোটবুক থাকতো। বন্ধুরা কখনো আফসোস করতেন যে তিনি তার এই প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেননি। বয়সের সাথে সাথে সিদ্ধান্তের দোলা চলে তিনি ফাদার জেম্ভেরকোভিচ এর শরণাপন্ন হন। ফাদারের কাছে তিনি পরামর্শ চান এই বিষয়ে। ফাদার তাকে বলেন ঈশ্বর যদি কাউকে সেবা করার সুযোগ দেন, এই কাজের জন্য নির্বাচিত করেন, তাহলে সে এতটাই গভীর আনন্দ অনুভব করবে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কোনো সংশয় থাকবে না। পরবর্তীকালে মাদার শিকার করেছিলেন যে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি কোন সংশয় প্রকাশ করেননি কারণ তিনি ঈশ্বরের বিশ্বাসী ছিলেন। ঈশ্বরের ওপরে সম্পূর্ণ আস্থা থেকেই তিনি এই জীবনটি বেছে নিয়েছিলেন।

১৯২৮ সালে ১৮ বছর বয়সী অ্যাগনেস স্কোপজে থেকে অল্প দূরে অবস্থিত লেদনিসের ম্যাডনার মন্দিরে কালো পাহাড়ের ঢালে প্রায়ই প্রার্থনা করতে যেতেন। এই জায়গাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তার পিতা নিকোলা জীবিত থাকাকালীন প্রায় তার পরিবারের সাথে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে এই তীর্থযাত্রায় যোগদান করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ড্রানা বছরে এখানে দুবার আসতেন। একবার কোনো তীর্থযাত্রীর দলের সাথে এবং অন্যবার একা। সারা বছর ধরে অ্যাগনেস এই তীর্থযাত্রার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। কিন্তু প্রায়ই ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে ড্রানা তাকে বাড়িতে রেখে আসতেন। এই মন্দিরেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি একজন সন্ন্যাসিনী হতে চান। তীর্থ যাত্রা থেকে ফেরার পরে তিনি তার মাকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। এই কথা শোনার পর তার মা নিজেকে গৃহবন্দী করে নেন। কিন্তু পরদিন সকালেই তিনি মেয়ের মাথায় আশীর্বাদের হাতটি রেখে বলেন-যে ঈশ্বরের নামে তিনি জীবন সঁপে দিয়েছেন, সেই জীবন যেন ভয়-ভীতিহীন এবং অনুশোচনাহীন হয়।ঈশ্বর তাকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করেছেন তাই তিনি আজীবন ঈশ্বরের নামেই সেবা যেন চালিয়ে যান। এই সময় অ্যাগ্নেসের দাদা লাজার যে কিনা বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে অস্ট্রিয়া তে নিজের পড়াশোনা করছিলেন এবং পরবর্তীকালে আলবেনিয়াতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হন, তিনি ছোটবোনের এই সিদ্ধান্ত শুনে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। অ্যাগনেস তাকে একটি চিঠিতে জানান যে তিনি হয়তো এক কেবলমাত্র একজন রাজার নিরাপত্তা রক্ষীর রূপে নিযুক্ত হবেন এবং সেবা করবেন, কিন্তু অ্যাগনেস সারা পৃথিবীর রাজা '' সেবা করতে চলেছেন।

অবশেষে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে অ্যাগনেস ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার পূর্বে প্যারিসে লোটেটো সিস্টার্সের মাদার সুপিরিয়র তার একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকার নেবেন। এটা যাচাই করে নেওয়ার জন্য যে অ্যগনেস সেই কাজের জন্য উপযুক্ত কিনা।১৯২৮ সালে ১৫ই আগস্ট শেষবারের মতো ম্যাডোনা মন্দিরে প্রার্থনা করতে যান। এরপর তিনি সোডালিটি গ্রুপের দেওয়া একটি কনসার্ট জয়েন করেন। এখানে তাকে সম্মান জ্ঞাপন করার পাশাপাশি একটি গ্রুপ ফটো তোলা হয়। ঐদিন বোজাক্সহিউ পরিবারে আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি বহু বন্ধু-বান্ধব তার সাথে দেখা করতে আসেন। এক বন্ধু তাকে একটি সোনার ফাউন্টেন পেন উপহার হিসেবে দেন। পরের দিন সকালে স্কোপজে রেলওয়ে স্টেশনে পরিবারের সাথে বন্ধুরা তাকে বিদায় জানাতে আসেন। ট্রেনে উঠে তিনি পরিবারের উদ্দেশ্যে বিদায় জানিয়ে আরেক অল্প বয়সে তরুণী বেটিকা কাঞ্জের সাথে প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এটি ছিল অ্যাগনেস এর সাথে তার মায়ের শেষ সাক্ষাৎ। সফরকালে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। লোরেটো সিস্টাররা তার আবেদন মঞ্জুর করলে পরিবার পরিজনের সাথে সারা জীবনের জন্য নিজের জন্মভূমি তিনি ত্যাগ করতে চলেছেন। পরিবারের সাথে পুনরায় সাক্ষাতের আর কোন সুযোগ থাকবে না। কিন্তু ট্রেন প্যারিস অভিমুখে এগোতে থাকলে অ্যাগনেস তার এই সিদ্ধান্তে অটল হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করেন

ঈশ্বরের নামে যে জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন সেখানে কোন সংশয় থাকবে না।

অ্যাগনেস র এই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে এক গভীর এবং কঠিন ইতিহাস রয়েছে।১৬০৯ সালে মেরি ওয়ার্ড নামে এক ইংরেজ মহিলা ব্লেসেড ভার্জিন মেরি নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।যার সাথে লোরেটো সিস্টার যোগদান করে। তারা সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তারা নারীদের একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। যা ক্যাথলিকদের ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে ছিল। দুস্থ মানুষগুলো সেবার্থে তারা ঈশ্বরের ভালোবাসা বহন করবেন। গির্জায় পুরুষ আধিপত্য রোধ করে একটি নারী শাসিত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করবেন।

জেসুইট রা মিশনারিজ এর পাশাপাশি শিক্ষকও ছিলেন। গির্জার কর্মকর্তারা তাদের স্বদেশ ডাব্লিনে ক্যাথলিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আইবিভিএম সিস্টারদের একটি স্কুল খোলার আমন্ত্রণ জানান। অবিলম্বে সিস্টারদের পাঠাতে অসমর্থ হলেও ফ্রান্সিস বল নামে একজন স্থানীয় মহিলার তত্ত্বাবধানে কিছু তরুণীকে নিয়ে তারা একটি স্কুলের ব্যবস্থা করেন। বল ইয়র্ক ভ্রমণ করেন এবং ডাব্লিন ফিরে আসেন। তিনি তেরেসা নাম নিয়ে রথফার্নহাম হাউসে ৩ জন সিস্টার কে নিয়ে বসবাস করা শুরু করেন। তেরেসা এই তিন সঙ্গীকে নিয়ে থাকার সময় সিদ্ধান্ত নেন তিনি এই রথফার্নহাম হাউসকে নাম দেবেন লোরেটো কারণ ইতালির এই গ্রামেই জোসেফ ,মেরি এবং যীশুর কাল্পনিক বাসস্থান ছিল। নামটি বিভ্রান্তিকর হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত লোরেটো সিস্টার্স নামকরণ করা হয়। যদিও সরকারি ভাবে ইনস্টিটিউট টি ব্লেসেড ভার্জিন মেরি নামে পরিচিত ছিল।১৮৪১ সালে একজন জার্মান ধর্মপ্রচারক টেরেসাকে ভারতবর্ষে কিছু সিস্টার পাঠানোর অনুরোধ করেন।ততদিনে আইরিসদের প্রজন্ম যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তালিকাভুক্ত ছিল, তারা বিবাহ করে সংসার জীবন যাপন করছেন। এরফলে বহু শিশু বাবা-মা মারা যাওয়ার ফলে অনাথ হয়ে জীবনের মূল স্রোত থেকে হারিয়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৮৩৪ সালে জেসুইটরা কলকাতায় প্রবেশ করে সেন্ট জেভিয়ার্স নামে একটি ক্যাথলিক স্কুল প্রতিস্থাপন করেন।যেখানে হিন্দু মুসলিম সবাই পড়াশোনা করত। শীঘ্রই মিলিটারি ফ্যামিলির অনুরোধে মহিলাদের জন্য একটি আলাদা স্কুল খোলার ব্যবস্থা করা হয়। মেয়েদের স্কুলের জন্য সিস্টারের প্রয়োজন হতে তেরেসাকে ভারতবর্ষে কিছু সিস্টার পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়।টেরিজা খুবই মৃদু কিন্তু কাঠিন্যের সাথে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ সেই মুহূর্তে আয়ারল্যান্ডে শিশুদের জন্য সন্ন্যাসিনীদের প্রয়োজন ছিল। কিছু জার্মান দর্শক তার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পুরোহিত সম্প্রদায়ের কাছে এটির বিরুদ্ধে মামলা করেন। ১৮৪১ সালে ২৩ শে আগস্ট মাত্র ৭ জন সন্ন্যাসিনী এবং দুজন ধর্মযাজক এবং ৬ জন সন্ন্যাসিনীদের কে নিয়ে ছোটো দল টি যাত্রা শুরু করে। প্রায় চার মাস পরে এই ছোট্ট দলটি কলকাতায় অবতরণ করেন। এই ছোট্ট দলটি পাঁচ মিডলটন রোডের একটি বাড়িতে থাকতে শুরু করেন এবং আরম্বরপূর্ণ সজ্জিত বাড়িটিকে একটি সাধারণ শ্রেণিকক্ষে রূপান্তরিত করেন। ৬৭ ফুটের এই ডাইনিং রুম টি শেষ পর্যন্ত একটি স্কুল হলে রূপান্তরিত হল। সিস্টারটা গির্জার ধর্ম প্রচার দের সাথে সাক্ষাতের পাশাপাশি স্থানীয় অনাথলয় শিশুদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।অবশেষে ১৮৪২ সালে ১০ ই জানুয়ারি লোরেটোস্কুল সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিত্তশালী পরিবার গুলিতে অনুদান চাওয়া হতো যাতে দরিদ্র শিশু গুলির জন্য বিনামূল্যে একটি স্কুল এবং অনাথ এবং বিধবাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়। প্রাথমিক রিপোর্টে খুশী হয়ে তেরেসা আরও বহু সিস্টারকে ভারতবর্ষে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।সেই মুহূর্তে বহু সন্ন্যাসিনী কলকাতায় কলেরায় মারা গেলেও এই স্বেচ্ছাসেবকদের ঢল থামেনি। এই অদম্য সাহসী শিক্ষকদের দলে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন অ্যাগনেস।

প্যারিসে আগমনের পর অ্যাগনেস এবং বেটিকে কে লরেটো হাউসের ইনচার্জ মাদার ম্যাকবিন এর সাথে সাক্ষাৎ করাতে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে দুজনের সাক্ষাৎপর্ব নেওয়া হয়। পরে অ্যাগনেস এবং বেটিকে কে ডাবলিনের একটি লরেটো অ্যাবেতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ন্যাসীদের পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত শাড়ি তাদের পরিধান করতে বলা হলো এবং আগামী ছয় সপ্তাহ ইংরেজির তালিম দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে বারণ করা হলো। বেটিকে এবং অ্যাগনেস যথেষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে এই আজ্ঞা গুলি পালনের সমর্থ হলেন।এর ফলে বাকি সিস্টারদের সাথে তারা পরিচয় করার সুযোগ পেলেন। মেরি ইমানুয়েল নামে অপর এক সন্ন্যাসিনী অ্যাগনেসকে পড়াশোনার বিষয়ে খুবই সাহায্য করলেন।আগামী ৬ সপ্তাহ পরে বেটিকে এবং অ্যাগনেস কে পুরোপুরি প্রস্তুত করে ভারতের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো।১৯২৮সালের ১ লা ডিসেম্বর তারা ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এই যাত্রাপথ ছিল দীর্ঘ এবং কঠিন। সুয়েজ খাল,লোহিত সাগর, ভারত মহাসাগর এবং অবশেষে ভূমধ্যসাগর উপর দিয়ে যাত্রা করেন। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে জাহাজের মধ্যেই ক্রিসমাস পালন করা হলো। কলম্বো পৌঁছানোর পর এক পুরোহিত সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গী হলেন। অবশেষে ১৯২৯-এ ৬ই জনুয়ারি জাহাজ কলকাতা বন্দরে প্রবেশ করল এবং এই মুহূর্তে অ্যাগনেসbনিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত হলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই ১৬ই জানুয়ারি অ্যাগনেস কে দার্জিলিং এর লরেটোতে পাঠানো হল যা কলকাতা থেকে যাওয়ার ৪০০ মাইল দূরে এক পাহাড়ি রাজ্য।

লরেটো কনভেন্টের জীবন ছিল খুবই শৃঙ্খলা বদ্ধ এবং কঠোর।একবিংশ শতাব্দীতে ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের জীবন সাধারনের জীবনের থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সে ছিল এক অন্য দুনিয়া, যেখানে সময়ানুবর্তিতার পাশাপাশি খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কর্তব্য পরায়ণ হতে হতো। পরবর্তী দু'বছরের জন্য অ্যাগনেস কে ইংরেজি শেখার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও শিখতে হয়েছিল। পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে কালো রঙের পোশাকে অভ্যস্ত হতে হল। নতুন সন্ন্যাসিনীদের দায়িত্বে উদ্ভাবকরা ছিলেন।প্রতি সপ্তাহে একবার করে কনভেন্টে যেতেন এবং তাদের সাথে সময় কাটাতেন। প্রতিদিন ৯ টা থেকে ১১ টা অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে অ্যাগনেস কুড়িটি বাচ্চাকে পড়াতেন একটি স্কুলে, যেটি ছিল কনভেন্টের সাথে সংযুক্ত। অনেক ছোট বাচ্চারা মিলিত হতো এবং এবং এটি অতি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করে। অ্যাগনেসের কঠিন পরিশ্রম এবং প্রফুল্ল স্বভাব তাকে ছাত্র মহলে জনপ্রিয় করে তোলে।১৯৩১ এর ২৪ শে মার্চ অ্যাগনেস প্রথম শপথ নিয়েছিলেন।সারা জীবন ধরে লোরেটর সিস্টার হিসেবে নিজের সতীত্ব,দারিদ্র্য এবং ঈশ্বরের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। প্রথা অনুযায়ী তিনি একটি নিজের নাম বেছে নিয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এক ফরাসি সন্ন্যাসিনী থেরেসার জীবনযাপন এবং কর্মকাণ্ড তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। খ্রিস্টের সেবা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি এবং এই সৃজনশীল কাজে সারা জীবন অতিবাহিত করবেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন একদিন এক ধর্ম প্রচারক হওয়ার। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন হ্যানয় বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার কার্মেলাইট ইনস্টিটিউশনে কাজ করবেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অল্প বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি তার কাজের সাথে মিলিয়ে তার নামকরণ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ইতিমধ্যে মেরি থেরেসা নামে একা সন্ন্যাসিনী ছিলেন।কিন্তু নিজের পছন্দের নাম পরিবর্তন না করার অভিপ্রায়ে তিনি ঠিক করলেন স্প্যানিশ বানানের সাথে মিলে নিজের নাম টেরেসা রাখবেন।কিন্তু সারা জীবন এই নামের জন্যে তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং প্রতিবারই তিনি যথেষ্ট ধৈর্যের সাথে এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। লরেটোর সিস্টারদের কাছে টেরেসার একটি ডাকনাম দেওয়া হল "বাংলা টেরেসা" কারণ বাংলা ভাষায় তিনি অতি দ্রুত তার দক্ষতা দেখিয়েছিলেন।

শপথ গ্রহণের অল্পদিনের মধ্যে তিনি সিস্টার টেরেসা নামে পরিচিত হন এবং দার্জিলিং থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে তিনি সেন্ট মেরি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এটি তার আগামী ১৭ বছরের কর্মজীবন এবং বাসস্থানে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা ছিল গতিশীল এবং মহাজাগতিক এক শহর এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এটি ছিল ব্রিটিশদের রাজধানী। ভারতের শিল্প সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি শহর,যার একদিকে ছিল প্রদীপের নিচে অন্ধকার এর মত গরীব অনাথের জায়গা। সিস্টার টেরেসা কে পূর্বাঞ্চলের এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।যেখানে লরেটো সিস্টারদের থাকার বন্দোবস্ত ছিল। এখানকার সন্ন্যাসী রা সেন্ট অ্যানের মেয়েদের সাথে মিলে ১৯৯৮ সালের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন। তারা বাকি সন্ন্যাসিনীদের মতো কালো পোশাকের পরিবর্তে ভারতীয় ঐতিহ্যের বাহক শাড়ি পড়তেন। গরমের জন্য তারা সাদা রঙের শাড়ি পড়তেন এবং শরৎ এবং শীতের মাসে তারা নীল রঙের শাড়ি পড়তেন।

সেন্ট মেরি স্কুলটি ধূসর রঙের দেয়াল এবং বিশাল লোহার গেট দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। প্রবেশদ্বার দিয়ে যেতেই একটি সুসজ্জিত খেলার মাঠ এবং লন চোখে পড়তো। প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি এখানে একটি শ্রেণিকক্ষ ছিল। শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি এখানে সন্ন্যাসিনীদের থাকার জন্য কোয়ার্টারের ব্যবস্থা ছিল। স্কুলটির অধিকাংশ শিশুই ছিল অনাথ এবং দরিদ্র পরিবারের। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৪১ সালে কলকাতা শহরে যে ছটি লরেটো স্কুল ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল এন্টালি এডুকেটেড অরফানস। যেখানে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করত। প্রত্যেকটি শিশুর একই পোশাক আশাক ছিল। স্কুলটিতে ভারতীয়দের পাশাপাশি বহু বিদেশি ছাত্রী পড়াশোনা করতো এবং স্কুলটিতে কোন বৈষম্য ছিল না। স্কুলটি লরেটো গার্লস নামেই বেশি পরিচিত ছিল। স্কুল থেকে পাশ করার পর বহু তরুণী সমাজ সেবার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।আবার কেউ কেউ অনেক উচ্চ স্তরে পৌঁছেছেন। কেবলমাত্র শিক্ষকতা না, হাইকোর্টের বিচারপতির পদেও কেউ আসিন হয়েছেন। এখানে ৫০০ জন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করতেন।সিস্টার টেরেজা এখানে থাকতেন এবং শিক্ষকতা করতেন। তিনি এখানে ইতিহাস এবং ভূগোল পড়তেন। বাংলায় সচ্ছন্দ হওয়া দরুন তিনি ক্লাসগুলি বাংলাতে করতেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিন্দি কে তৃতীয় ভাষা হিসেবে সংযুক্ত করেছিলেন। এককালে ঘোড়ার আস্তাবল বলে পরিচিত একটি রুমকে একটি শ্রেণী কক্ষের রূপ দেয়া হয়। লরেটো স্কুল এবং কনভেন্ট আলাদা হওয়া সত্ত্বেও এখানকার পরিবেশ ছিল খুবই নোংরা। প্রায় দিন ই শিক্ষাদানের পরে সিস্টার টেরিজা তার অভ্যাসবশত জামার হাতা গুটিয়ে জল এবং ঝাড়ু নিয়ে ঝাড় দিতেন এবং ছাত্র-ছাত্রীরা এটি বিস্ময় হয়ে দেখত। কিন্তু তার কাছে এটি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার যা তিনি রোজ পালন করতেন। এই দায়িত্বের মধ্য দিয়ে তিনি সচ্ছন্দ অনুভব করতেন। প্রায় একটি শিশু যার পরিধানে ছিল নোংরা কাপড়, কপালে হাত দিয়ে টেরেজা কে মা বলে সম্বোধন করত। এই ভালোবাসা এবং স্নেহ তিনি অর্জন করেছিলেন। শিশুদের জন্য তিনি ক্লাসের আয়োজন করতেন এবং এক প্রাক্তন ছাত্রের মতে তিনি এই কাজটি খুবই স্নেহভরে করতেন এবং শিশুদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি নজর দিতেন। প্রায়দিন শিশুদের জন্য কোন না কোন উপহার থাকতো এবং সেটা বেশিরভাগ দিনে সাবান হত। প্রাক্তন ছাত্রদের মতে টেরেজা ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষিকা। দুপুরের ক্লাসে তিনি প্রায়ই স্কোপজের দিনগুলির কথা বলতেন এবং তার ভূগোলের ক্লাসটি ছিল অসম্ভব উৎসাহের। সর্বদা তিনি নিজেকে বহু কাজে ব্যস্ত রাখতেন। স্কুলের দিনগুলি ছিল দীর্ঘ। দিন শুরু হত ভোর পাঁচটায়।ওঠার পর প্রত্যেকটি সিস্টার প্রার্থনা করতেন এবং তাদের নির্ধারিত ধর্ম গ্রন্থ গুলি পাঠ করতেন। সকাল ন'টা থেকে ক্লাস শুরু হতো। বিকেলের চা পর্বের পর সেন্ট মেরির অন্যান্য বাচ্চাদের দেখাশোনা করা হতো। সেখানেই শিশুদের পাঠ সংশোধনের পাশাপাশি বিনোদনের সময় নির্ধারণ করা হতো। শিশুদের ঘুমোনোর এবং সন্ধ্যার খাবারের তদারকি করতেন তিনি। সবকিছু সময় মত শেষ করার জন্য শৃঙ্খলা অপরিহার্য ছিল। কখনোই কোন আদেশ পালনে কেউ ব্যর্থ হতেন না। গোটা স্কুলের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন এক ধার্মিক মহিলা রূপে। দেখনদারিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। সর্বদা ঠোঁটে লেগে থাকত এক নির্মল হাসি। তিনি তার হাস্যরসের জন্য পরিচিত ছিলেন। সর্বদা কোন কৌতুক বা মজার কথা বলার সময় তিনি তার কোমরে হাত দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়তেন। লরেটো সন্ন্যাসিনীরা অত্যন্ত দারিদ্রতার সাথে জীবন যাপন করলেও সিস্টার টেরেজার সর্বদা নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সর্বদা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেন। কখনো কোন অভিযোগ না করে নিজের নম্র এবং ভদ্র ব্যবহার দিয়ে তিনি সবার কাছে প্রিয় পাত্রী হয়ে ওঠেন। প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন না হলেও তার শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অনন্য। এক সিস্টার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন "মাদার ছিলেন খুবই সাধারণ এক সন্ন্যাসিনী, যিনি তার সারাটা জীবন ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করেছেন"। সিস্টার টেরেসা ব্লেসেড এর সোডালিটি কে সাহায্য করতেন যা স্কোপজে তে তার জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফাদার হেনরি ছিলেন একজন বেলজিয়ান জেসুইট। এই গ্রুপের আয়োজিত ক্লাব পার্টি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করতেন। ফাদার হেনরির সহায়তায় সোডালিটির হয়ে মাদার তেরেসা বহু দুস্থ নারীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

অন্যদিকে কনভেন্ট ছিল বসতি এলাকায় অবস্থিত, যা মতিঝিল নামে পরিচিত ছিল। একটি বিশাল পুকুরকে কেন্দ্র করে এলাকাটি পরিবেষ্টিত ছিল। পুকুরের জলই অধিবাসী রা স্নান করার পাশাপাশি খাবার জল এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করতেন। অঞ্চলটি ছিল ভীষণ নোংরা এবং দারিদ্র্যে পরিপূর্ণ। ফাদার হেনরির কাছে এটা এক বড় সুযোগ ছিল সেন্ট মেরির মেয়েদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করা। প্রত্যেক সপ্তাহে ক্লাস শেষের পরে ফাদার হেনরি মেয়েগুলোর সাথে দেখা করতেন। এক শনিবার মেয়েরা তাদের কম্পাউন্ডের দেওয়াল ছেড়ে একদল মতিঝিলের ওই সমস্ত দরিদ্র পরিবারগুলির সাথে সাক্ষাৎ করতে গেল এবং অন্য দল নীলরতনে অসুস্থদের দেখতে। সেখানে তারা চিঠির মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতেন। সিস্টার টেরেজা কোন প্রচেষ্টা ছাড়েননি তার ছাত্রদের এই সমস্ত কাজে নিমজ্জিত করতে। কিন্তু তিনি লোরেটর সন্ন্যাসিনীদের ঘোর নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের সাথে যোগ দিতে পারতেন না এবং সম্ভবত এটি ছিল তার কলকাতার এই দরিদ্র মানুষগুলোর সাথে সবথেকে বড় পরোক্ষভাবে সংযোগ স্থাপন।

১৯৩৭ এর ২৪ শে মে সিস্টার টেরেজা তার চূড়ান্ত শপথের জন্য দার্জিলিং এ উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন টেরেসা আন্তরিকভাবে নিজেকে দারিদ্র ও সেবার আনুগত্যের প্রতি আজীবন নিজেকে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ করেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি মাদার টেরেসা নামে পরিচিত লাভ করেন যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বহন করেছেন। কলকাতায় ফিরে তিনি পুনরায় নিজের ব্যস্ততার জগতে ডুব দেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সফল হন এবং ভারতবর্ষ তার নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়।

মাদার তেরেসা ভারত ভ্রমণের প্রাক্কালে ভারত বর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে উজ্জ্বল ছিল না। ১৯২৯ সালের মধ্যে তিন শতাব্দীর বেশি সময় ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ অধীন এবং এটি বাদ দিয়ে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা ভারতবর্ষে শাসন করেছিল। কেবলমাত্র ব্রিটিশ শাসন না,আরো বহু ইউরোপের দেশ ভারতবর্ষে নিজের অধিকার কায়েম করতে চেয়েছিল। তার মধ্যে পর্তুগিজরা ভারতবর্ষ প্রথম নিজেদের বলে দাবি করে। পর্তুগিজদের পাশাপাশি ডাচ, ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন জয়লাভ করে। ১৬০০ সালে কেবলমাত্র একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে তারা রাজনৈতিক শাসক কে পরিণত হয় এবং ১৮৪৯ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে নিজেদের শাসন কায়েম করেছিল ।তারা মিশনারিজকে নিয়ে ভারতীয়দের ইংরেজি রীতিনীতি শেখানোর চেষ্টা করে।কিন্তু সমস্ত ভারতীয় তাদের নিজেদের ঐতিহ্য,রীতি-নীতি ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিল না।যার ফলে দেশে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। ১৮৫৭ সালের এই অস্থিরতা এক প্রকার বিস্ফোরণের রূপ নেয় যখন এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ভারতীয় সৈনিকদের যে সমস্ত রাইফেলের কার্তুজ মুখ দিয়ে ছিঁড়তে হতো,সেই কার্তুজ গুলি গরু এবং শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি ছিল। গরু ছিল হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা অপরদিকে মুসলিমরা শুকর ঘৃণা করতো। এর ফলে দেশে সিপাহী বিদ্রোহ দেখা দেয়। যার ফলস্বরূপ বহু ব্রিটিশ সৈন্য মারা যায়। এর ফলে ব্রিটিশ টা মনে করতে থাকে ভারতবর্ষে তাদের শাসনের দিন শেষ হয়ে আসছে। ফলে তারা ভারতবর্ষে ভাইসরয় নিযুক্ত করে। ১৮৭৬ সালে পার্লামেন্টে দ্বারা এই নিয়ম লাগু হয় এবং ওই বছরই রানী ভিক্টোরিয়ার হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়।

এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এই ধরনের বিদ্রোহ এড়ানোর জন্য ব্রিটিশরা নানারকম পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ভারতবর্ষে হিন্দু এবং মুসলিম মিলিয়ে প্রায় ৬০০ জন রাজা ছিলেন যারা স্বায়ত্ব শাসন করতেন। তারা যাতে নিজেদের মধ্যে কোন যুদ্ধ না ঘোষণা করতে পারেন, তাই জন্য কোম্পানির দ্বারা একটি করে জনপ্রতিনিধি নিযুক্ত ছিল। এই জন প্রতিনিধিরা ভাইসরয়কে নানা রকম পরামর্শ দিতেন যাতে ভারতবর্ষের আভ্যন্তরীণ শান্তি বিঘ্নিত না হয়। ভারতবর্ষে শাসনের পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছিল। রাস্তা,রেলপথের পাশাপাশি খাল- সেচ,কলকারখানা তৈরি করেছিল। পশ্চিমী দেশগুলোর মতো এদেশে তারা পুলিশ এবং আইনি ব্যবস্থা চালু করেছিল এবং বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর ফলে ভারতবর্ষের একটি বুদ্ধিজীবী দের ক্রমবর্ধমানসংখ্যা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একটি স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এর ফলস্বরূপ ১৮৮৫সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয় এবং যাদের লক্ষ্যই ছিল ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করে এক স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠা করা।

১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ ভারত বর্ষে আছড়ে পড়ে। ব্রিটিশরা ভারতীয় সেনাদের জোর করে জার্মানদের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির হয়ে লড়াই করতে। এই সময় ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বৃদ্ধি পায়। এই আন্দোলন গুলি দমন করতে ব্রিটিশরা ১৯১৯ সালে একটি সংস্কার আইন পাস করে। কিন্তু এটি চরম জাতীয়তাবাদী নেতাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। গান্ধীজী এই সময় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন এবং তিনি অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার প্রচার শুরু করেন। এর ফলে সারা ভারত বর্ষ জুড়ে কংগ্রেস বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯২৭ সালে ভারতবর্ষে দাঙ্গা শুরু হলে ব্রিটিশরা গান্ধীজিকে জেলবন্দি করে।তারা একটি কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য। কিন্তু ব্রিটিশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এই আন্দোলন দমন করার। জহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৫ সালে ভারতবর্ষের ব্রিটিশরা একটি আইন আনে- কিছু ভারতীয় তাদের শিক্ষা এবং মেধার ভিত্তিতে ভোট দান করতে পারবে এবং নানা রকম প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হতে পারবেন। এইরকম পরিস্থিতিতে মাদার তেরেসা ভারতবর্ষে তার কাজ করতে এসেছিলেন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ বাড়তে থাকে।১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পূর্বের ন্যায় ব্রিটিশরা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিনতি ভারতবর্ষের জন্য ছিল ভয়ংকর।১৯৪২-৪৩ সালে ভারতবর্ষে মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।যে সমস্ত ছোট ছোট নদীগুলি দিয়ে বাংলা থেকে কলকাতায় চাল রওনা দিত,সেগুলিকে ব্রিটিশরা তাদের সামরিক বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে রাখে। যার পরিনামে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। কালোবাজারি বাড়তে থাকে। গ্রামীন এলাকা গুলোতে দরিদ্র মানুষগুলি তাদের জমিজমা বিক্রি করে খাবার সংগ্রহ করতে থাকে। বহু মানুষ কলকাতার উদ্দেশ্যে পালিয়ে যান। দুর্ভিক্ষের ফলে অনাহারে অপুষ্টিতে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। যুদ্ধের ফলে রাস্তায় জাপানি শরণার্থীদের ভীড় এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। এই মহা দুর্ভিক্ষ অন্তত ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। মৃত্যু মিছিল এতই ভয়ংকর ছিল যে রীতিনীতি মেনে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ হয়নি। এন্টালি সন্ন্যাসিনী রাও এই যুদ্ধের প্রভাব অনুভব করেছিলেন। যুদ্ধের ফলে লরেটো কনভেন্টের দরজায় অনাথ শিশুদের সংখ্যাক্রমে বাড়তে থাকে। এই যুদ্ধের আবহে জন্ম নেওয়া ২৪ টি সদ্যোজাত শিশুকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় তা নিয়ে মাদার টেরেজা শঙ্কিত ছিলেন। জাপানি শরণার্থীরা কনভেন্টের দরজায় এবং স্কুলে তাদের আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। শরণার্থীদের জন্য ক্যাথলিকরা কনভেন্টের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এই সময় ব্রিটিশ বাহিনী এই স্কুলগুলিকে নিজেদের হসপিটালে রূপান্তরিত করে। এক সময় যেখানে ছোট ছোট শিশুদের করতালিত ভরে থাকতো ,সেখানে এখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মুমূর্ষ,আঘাতে জর্জরিত সৈনিকদের সেবা সুশ্রূষা দান করা হয়। এর ফলে কনভেন্ট এর সন্ন্যাসীরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দার্জিলিং, শিলং এবং লখনউ হোটেলে স্থানান্তরিত হন। মাদারটেরেজা কলকাতায় কনভেন্ট রোডে একটি ভবনে থেকে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম গুলি চালিয়ে যান।

১৯৩৭ সালে মাদার টেরেজা কে সেন্ট তেরেসা প্রাইমারি স্কুলের পাশাপাশি সানডে স্কুলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালে যখন মাদার ডু সিনাকাল অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন মাদার তেরেসাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যা তার ওপর অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি শিশুদের এই দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করতে চাননি। স্কুল স্থানান্তরিত হলেও মাদার টেরেজা সর্বদা এটা নিশ্চিত করেছেন যে বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবন যতটা সম্ভব অক্ষত রাখা। এই সময় মাদার এমন এক ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন,যিনি কিনা আগামী ৪৫ বছর তার আধ্যাত্মিক উপদেষ্টার পাশাপাশি সহচর হিসেবে কাজ করেছেন। ফাদার ভান এক্সেম ছিলেন একজন বেলজিয়ান জেসুইট।যিনি ১৯৪৪সালে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। আরবি এবং মুসলিম ধর্মে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। কলকাতার মুসলিমদের হয়ে কাজ করার অভিপ্রায়ে তিনি এসেছিলেন।১১ই জুলাই তিনি এবং তার সহচর বৈঠাখানায় এক বাড়িতে আসেন যা মাদারটেরেসা র কনভেন্ট রোডের বাড়ি থেকে বেশি দূরে ছিল না। ফাদারের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে মাদার তাকে কনভেন্টের দায়িত্বের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন আমি ভারতবর্ষে মুসলিমদের হয়ে কাজ করতে এসেছি, কোন সন্ন্যাসিনী দের জন্য নয় এবং আমি বুদ্ধিজীবীদের সাথে কাজ করতে চাই,কোন সন্ন্যাসিনীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই না। কিন্তু পরের দিন ফাদার পুনরায় মাদারের সাথে দেখা করেন। ফাদারের সাথে বহু বিষয়ে আলোচনার পর মাদার আবার তাকে আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার অনুরোধ করেন। এই মুহূর্তে ফাদার মাদার কে পরামর্শ দেন যে তিনি যদি কলকাতার আর্চবিশপ কে লিখিত অনুরোধ জানান তবে তিনি ভেবে দেখবেন। মাদার বিশপ কে অনুরোধ জানালে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং অনুমতি দেন ফাদারকে। একপ্রকার অনিচ্ছায় ফাদার মাদারের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাদার টেরেজা প্রায়ই আধ্যাত্মিক পরামর্শের জন্য ফাদারের কাছে যেতেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরে মাদার টেরেজা এন্টালিতে তার কনভেন্টে ফিরে যান। চিঠির মাধ্যমে তিনি তার মায়ের কাছে তার এই কলকাতার জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন। ড্রানা এখন তিরানায়, যেখানে আগা এবং লাজার থাকেন, সেখানে চলে গিয়েছিলেন। ড্রানা তার মেয়েকে ভারতে তার কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন সেই দরিদ্র মানুষগুলোকে গ্রহণ করতে, যাদের আর অন্যরা গ্রহণ করে না। এই পরামর্শ মাদার কে পুনরায় কনভেন্টে তার দায়িত্ব পুনর্বিবেচনা করতে সাহায্য করেছিল।

জাপানের সাথে শত্রুতা শেষ হওয়ার পরে ভারতবর্ষ এবং কলকাতা ফের এক ভয়ংকর রক্তপাতের সম্মুখীন হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ রাজ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার কাজ করে চলেছিল। এই সময় কংগ্রেসের হয়ে কাজ করছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগ, যারা কংগ্রেসকে চাপ দিচ্ছিল ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত মুসলিমদের নিয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়তে। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগ কলকাতার ময়দানে একটি সভা অনুষ্ঠিত করে। এই সবার সদস্যদের উস্কানি মূলক বক্তৃতা গুলি জনতার মধ্যে এতই প্রভাব বিস্তার করে যে আগামী চারটে রাত কলকাতা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন হয়। কলকাতা নগরী প্রত্যক্ষ করেছিল হিন্দু এবং মুসলিমদের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। জঙ্গিরা দোকানগুলিতে আগুন লাগানোর পাশাপাশি নারী পুরুষ বাচ্চা কে নির্বিচারে হত্যা করে। বিবর্ণ ফুটপাত গুলি ওই অসহায় মানুষগুলির রক্তে রাঙিত হয়েছিল। সর্বত্র মৃতদেহের ছড়াছড়ি। এই দাঙ্গায় কমপক্ষে ৫ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং ১৫ হাজার আহত হয়েছিলেন। এই দাঙ্গার ফলে মাদার টেরেজা এবং তার প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী চরম খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। প্রথমবার মাদার লরেটর নিয়ম নীতি উলঙ্ঘন করে রাস্তায় নেমেছিলেন খাদ্যের সন্ধানে। পরবর্তীকালে অনেক বছর পর তিনি যখন এই দৃশ্যটি বর্ণনা করছিলেন যে-আমি যখন সেন্ট মেরি থেকে বেরিয়েছিলাম তখন আমার স্কুলে ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী ছিল,যাদের কাছে খাবার বলতে কিছুই ছিল না।আমার অনুমতি ছিল না বাইরে যাওয়ার। কিন্তু আমি বাধ্য ছিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রাস্তায় চারিদিকে অনেক লাশ পড়ে আছে। এই সময় সৈন্যদের একটি ট্রাক আমায় এই পরিস্থিতিতে বাইরে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে আমি তাদের কনভেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বলি। তারা আমাকে কনভেন্টে দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সাথে মজুদ চাল দান করেছিল। এই দাঙ্গার পরে মাদার তেরেসা শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। যার ফল স্বরূপ তাকে প্রত্যেকদিন বিকেলে তিন ঘন্টার জন্য বিশ্রামের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি যক্ষা রোগের আশঙ্কা করছিলেন কারণ সেই সময় কলকাতায় এই রোগে অনেক সন্ন্যাসিনী ভুগছিলেন। ফাদার এক্সেম প্রথম বার মাদারকে দুঃখ করতে দেখেছিলেন কারণ তিনি তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলেন না। এই সময় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মাদার তেরেসাকে তার যাবতীয় দায়িত্ব থেকে সাময়িক বিরতি দেওয়ার। তাকে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, যেখানে তিনি ধ্যান এবং বিশ্রামের ফলে সুস্থ হয়ে উঠবেন। ১৯৪৬ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর এই দিনটি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি 'অনুপ্রেরণা দিবস' হিসেবে পালন করে। এই ট্রেন সফরে তার এক ঐশ্বরিক উপলব্ধি হয়েছিল। তিনি ঈশ্বর এর বার্তা পেয়েছিলেন যা ছিল খুবই পরিষ্কার। ঈশ্বর তাকে আদেশ করেছিলেন- "লোরেটো র স্থায়ী জীবন ত্যাগ করে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতমদের সেবা করা। এই আদেশের অন্যথা হলে ঈশ্বর খুবই দুঃখ পাবেন এবং ঈশ্বর তাকে এই কাজের জন্য নির্বাচিত করেছেন"।

"এই অনুপ্রেরণা দিবস টি মাদারের জীবনের সন্ধিক্ষণ"-এ নিয়ে বহু জন দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার জীবনে এমন বহু ঘটনা ছিল যা তাকে তার এই সিদ্ধান্তের জন্য উৎসাহিত করেছিল। এক সূত্রের মতে, ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় তিনি যে পরিমাণ হত্যা দেখেছিলেন তা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অপর একটি সূত্রের মতে,তিনি তার শোয়ার ঘর থেকে কলকাতা অঞ্চলের বস্তি এলাকাগুলো দেখতে পেতেন যা তাকে তার কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিল। কলকাতার দারিদ্রতা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন।যখন প্রথম তিনি কলকাতায় পদার্পণ করেছিলেন,তিনি আশেপাশে এই দারিদ্রতা উপলব্ধি করেছিলেন। কারণ লোরেটোর বেশিরভাগ শিশুই ছিল দরিদ্র এবং অনাথ পরিবারের। এই মানুষগুলির সেবা করতে হলে একদিন তাকে লরেটোর এই শান্ত নিশ্চিন্ত জীবন ত্যাগ করতেই হত। তিনি হয়তো সারা জীবন লরেটো সন্ন্যাসিনী রূপে ঈশ্বরের সেবা করতেন কিন্তু এই দার্জিলিং সফরকালে ঈশ্বরের এই বার্তা পাওয়ার পর তিনি নিজের জীবন দর্শন সম্পর্কে পুনরায় সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে মাদার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন ঈশ্বরের বার্তাটি পাওয়ার পর তিনি নিশ্চিত ছিলেন তিনি কোথায় আছেন কিন্তু তিনি জানতেন না তিনি কিভাবে সেখানে পৌঁছবেন, যেখানে ঈশ্বর তাকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অবিলম্বে তিনি ফাদার ভ্যানের সাথে সাক্ষাৎ করার অনুরোধ জানান। দার্জিলিং থেকে ফেরার পর তিনি ফাদারের সাথে দেখা করে চিঠির মাধ্যমে তার পরিকল্পনার কথা জানান। ফাদার চিঠিটি মাদার মেরির ছবির নিচে রেখে বেরিয়ে যান। দুঘন্টা পর তিনি ফিরে এসে পুনরায় চিরকুটগুলি প্রত্যক্ষ করে ভাবতে থাকেন কিভাবে মাদার কে লোরেটোর এর এই জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। মাদার এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি আজীবন তার শপথ বাক্য অনুযায়ী সন্ন্যাসিনী থাকবেন কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি দরিদ্রদের সাথে মিশে তাদের সেবা করতে চান।মাদার কিছু সিস্টার দের নিয়ে একটি নতুন ধর্মসভা গঠন করেছিলেন,যেখানে তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতমদের মাঝে থেকে তাদের সেবায় নিজেদের ব্রতী করবেন এবং এই ধর্ম সভায় সন্ন্যাসীদের একটি বিশেষ বাক্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। সেখানে কোন হসপিটাল বা কোন প্রতিষ্ঠান বা ক্লিনিক ছিল না যারাই দরিদ্রদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক। ফাদার কখনোই মাদারের কাছে তার এই সিদ্ধান্তের কোন ব্যাখ্যা চাননি। ফাদার বিশ্বাস করেছিলেন মাদার তেরেসার এই সিদ্ধান্ত ততটাই সত্য যখন তিনি অল্প বয়সে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে একজন সন্ন্যাসিনী হয়ে ভারতবর্ষে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অল্প বয়সে তিনি তার মা পরিবার-পরিজন ছেড়ে এই অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়িয়েছিলেন,সেখানে তার এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করার কোন সুযোগই ছিল না। অক্টোবরে লরেটোতে ফিরে আসার পর তিনি একটি নতুন সম্ভাবনার বীজ বপন করেছিলেন। মাদার কতগুলি মৌলিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। যিশুর ছবির উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে তিনি কান্নারত অবস্থায় বলেছিলেন" আমি তৃষ্ণার্ত"। এই কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি যাদের নির্বাচিত করেছিলেন তারা কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন না,হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে আগত আনুগত্যের সহিত এই দায়িত্ব পালন করবেন। এই দরিদ্র মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে তারা তাদের জীবন অর্পণ করেছেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। পরবর্তীকালে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মাদার বলেছিলেন "নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করার থেকেও লোরেটোর এই জীবন ত্যাগ করা কষ্টকর ছিল।"

১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মাদার আর্চবিশপ ফার্দিনান্দ পেরিয়ার কে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখেন। ফাদার এক্সেম মনে করেছিলেন বিশপ হয়তো খুব সহজেই মাদার কে অনুমতি দান করবেন। কিন্তু তিনি ভুল প্রমাণিত হলেন। কয়েক বছর পর আর্চবিশপ স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন,তিনি প্রথমবার যখন মাদারের সম্পর্কে শুনলেন তিনি এন্টালি র কনভেন্ট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে বলা হয়েছিল যে কনভেন্টের এক সন্ন্যাসিনী কিছু অন্য সন্ন্যাসিনীদের নিয়ে একটি নতুন ধর্মসভা গঠন করেছে। তিনি মনে করেছিলেন যে এতে হয়তো ঈশ্বরের হাত নেই কিন্তু সন্ন্যাসিনী টি যদি নম্র,ভদ্র হয় তাহলে ঈশ্বর অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেবেন। মুক্তমনা হওয়া সত্বেও পেরিয়ার এটি বিশ্বাস করতে পারেননি যে একজন একাকী সন্ন্যাসিনী কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে হতদরিদ্রদের সেবা করবেন এবং তিনি শংকিত ছিলেন যে,একা সন্ন্যাসিনী সমস্ত নিয়ম-নীতি বাইরে একটি নতুন আদর্শ বাস্তবায়িত করায় ব্রতী হয়েছেন। তিনি ফাদার এক্সাম এর সাথে দেখা করে আলোচনা করেন এবং মাদার কে আসানসোলে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে রান্নার পাশাপাশি বাগান পরিচর্যা এবং ভূগোল বিষয়ে শিক্ষাদান করেন মাদার। ফাদার এক্সেম সেই মুহূর্তে মাদার কে তার নতুন পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করতে বারণ করেন। এই দুজন মানুষ চিঠিপত্রের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। এন্টালি থেকে দূরে থাকার সময় ফাদার পেরিয়ার মাদার এর সম্পর্কে দার্জিলিং এর সেন্ট মেরি চার্চের ধর্মতত্ত্বের এক শিক্ষকের সাথে আলোচনা করেন। বিশপ চিন্তিত ছিলেন যে একজন ইউরোপিয়ান সন্ন্যাসীনী ভারতীয় ঐতিহ্যের শাড়ি পড়ে কলকাতার রাস্তায় দরিদ্রদের সেবা করবেন । দুজনে শংকিত ছিলেন যে এই আধুনিক পদক্ষেপ সফল হবে কিনা, জনসাধারণ এই পদক্ষেপকে কিভাবে নেবেন। এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি জুয়া খেলার মত। বিশপ ফাদার হেনরির কাছে কলকাতার দরিদ্রদের নিয়ে জানতে চান তাদের নিয়ে কি কাজ করা হচ্ছে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন এই নতুন পদক্ষেপটির সফলতার জন্য।কিন্তু তিনি ফাদার হেনরি কে বারণ করেন এই পদক্ষেপ যে মাদার তেরেসার, সেটা সবাইকে জানাতে। কারণ তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে ভ্যাটিকান সিটি কখনোই এক মহিলা দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে যেতে দেবে না কারণ তখনকার সমাজে ক্যাথলিক মহিলাদের জন্য অনেক নিয়ম নীতি ছিল।

বিশপ কে একটি নতুন সংগঠনের অনুমতি দেওয়ার আগে এটা দেখাতে হয়েছিল যে, পুরনো আদেশ গুলি ঠিকঠাক মতো পালন না করার জন্যই এই নতুন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কলকাতায় সেন্ট অ্যানির মেয়েরা ইতিমধ্যে দরিদ্রদের জন্য কাজ করছিলেন যার সাথে মাদার লরেটো স্কুলে কাজ করেছেন। তারাও একটি সহজ সরল জীবন যাপনের পাশাপাশি ভারতীয় পোশাক পরিধান করতেন এবং বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। ফলে মাদার টেরেসার এই সংগঠন কোন দিক থেকে আলাদা ছিল তা বিচার না করে আর্চ বিশপ তাকে অ্যানির মেয়েদের সাথে কাজ করার পরামর্শ দেন। মাদার খুবই নম্র এবং ভদ্রভাবে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সেন্ট অ্যানির মেয়েদের আদর্শ ছিল ভিন্ন এবং মাদারের আদর্শ ছিল ভিন্ন।মাদার বলেছিলেন "তিনি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতমদের সেবা করতে চান"। তিনি তার এই নতুন সংগঠনের মেয়েদের এক নতুন আদর্শে ব্রতী করতে চেয়েছিলেন।

এক বছর পর আর্চ বিশপ মাদার তেরেসাকে লোরেটো সুপিরিয়ারদের কাছে একটি চিঠি লেখার আদেশ করেন। এই চিঠিতে ফাদার এক্সেম মাদার কে সাহায্য করেন তার আদর্শ গুলি ব্যাখ্যা করতে। তিনি চিঠির দ্বারা প্রকাশ করেন যে তিনি কনভেন্ট ত্যাগ করলেও আজীবন সন্ন্যাসীনী হয়ে এই দরিদ্রদের সেবার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান। কনভেন্ট ত্যাগের সিদ্ধান্তে মাদার ব্যথিত হলেও ফাদার তাকে আশ্বস্ত করেন যে তাকে ঈশ্বরের ওপরে সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। এই চিঠিটি রথফার্ন হাম হাউসের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয় ১৯৪৮ সালে। এক মাসের ও কম সময়ের মধ্যে এই চিঠির উত্তর পাঠানো হয়। মাদার জেনারেল এই নতুন কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত বোধ করেছেন এবং তিনি তাকে অনুমতি দিয়েছেন রোমের ধর্ম মন্ডলীকে একটি চিঠি লিখতে এবং তিনি বারবার বলেছেন যে তিনি যেন কখনোই তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা না করেন।

মাদার জেনারেলের কাছে থেকে কোন শক্তিশালী সমর্থন না পেলেও ফাদার এবং মাদারটেরেজা তার এই অনুমতিতে ভীষণ খুশি ছিলেন। মাদার টেরিজা এবার একটি চিঠি রোমের ভাটিকানের উদ্দেশ্যে লিখলেন। যদিও মাদার জেনারেল তাকে কোন আলোচনা করতে বারণ করেছিলেন তবু ফাদার এর সহায়তায় আর একটি চিঠি তিনি বিশপ এর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন। কার্ডিনালকে চিঠি লেখার উদ্দেশ্যে মাদার উদ্বিগ্ন ছিলেন,তিনি ফাদার এর সহায়তা চান। ফাদার তাকে সহজভাবেই "প্রিয় পিতা" সম্বোধন করে লিখতে বলেন। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চিঠিটি রোমের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয় এবং আর্চ বিশপ কে অনুরোধ করেন কলকাতায় তার কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আরেকটি চিঠি লিখতে। ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে রোম থেকে এর উত্তর আসে। আর্চ বিশপ ফাদার কে অবিলম্বে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। ভ্যাটিকান সিটি মাদার তেরেসাকে অনুমতি দিয়েছেন লরেটর সদস্য হিসেবে কনভেন্ট ত্যাগ করে বাইরে কাজ করতে। এটি ছিল মাদার তেরেসার প্রথম জয় যা তাকে মেরি ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত এই কনভেন্টের বাইরে গিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই সম্মতি প্রদানের পেছনে কিছু শর্ত ছিল। মাদার টেরেসাকে এক বছর বাইরে কাজ করে বিশপকে তার এই কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে চিঠি লিখে রোমে জানাতে হবে। বিশপ ফাদার কে বারণ করেছিলেন তৎক্ষণাৎ মাদার কে এই খবর দিতে। ফাদার বাধ্য হয়ে এই শর্তে রাজি হন। ১৯৪৮ এর ৮ ই আগস্ট রবিবার ফাদার তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সকালে লরেটো কনভেন্টের কাজ করছিলেন। প্রথমে বাংলা এবং পরে হিন্দিতে তার সম্ভাষণ দেন।পরে তিনি মাদার তেরেসাকে কনভেন্টে ডেকে রোম থেকে আসা উত্তরের ব্যাপারে খবরটি দেন। প্রথমে মাদার সাময়িক অবাক হলেও পরে তাকে ফাদার এই সুখবরটি প্রদান করেন যে রোম তার এই নতুন উদ্যমে অনুমতি দিয়েছে। এরপর মাদার তিনটি কপি সাইন করেন একটি রোম, একটি বিশপ এবং একটি তার নিজের উদ্দেশ্যে।এরপর তিনি ফাদারের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেন 'এইবার আমি কনভেন্ট ছেড়ে এই জনসমুদ্রে মিশতে পারি'?

মাদার যত শীঘ্রই সম্ভব কাজ শুরু করতে চাইলেও কিছু নিয়ম-নীতি তখনও বাকি ছিল। প্রথমেই তাকে তার এই কনভেন্ট ত্যাগ করার কথা জানাতে হত। বিশপ এবং বাকি সন্ন্যাসীনীদের কথা চিন্তা করে তিনি প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলেন।তার এই ভয় অমূলক ছিল না কারণ ঘোষণাটি হওয়ার পরে মাদার সুপিরিয়র এক সপ্তাহ বিছানা নিলেন এবং অন্য একটি সিস্টার কাঁদতে শুরু করলেন। অনেকেই রীতিমতো বিস্মিত হলেন যে তাদেরই মধ্যে একজন,যিনি কিনা নিজের আশেপাশের কাজকর্ম নিয়ে এতই জনপ্রিয় ছিলেন ,তিনি হঠাৎ করে কনভেন্ট ত্যাগ করবেন। এরমধ্যে অনেকে মাদারের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন কারণ এই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি কলকাতার রাস্তাঘাটে সেবা করবেন। ব্ল্যাকবোর্ডে একটি নোটিশ দেওয়া হল যেখানে লেখা ছিল যে বাকি সন্ন্যাসীরা, তার এই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন না প্রশংসাও করছেন না,ঈশ্বরের কাছে কেবলমাত্র প্রার্থনা করবেন তার সফলতার। কনভেন্ট ত্যাগের পূর্বে তিনি লোকাল বাজার থেকে নীল রঙের পাড় দেওয়া তিনটি সুতির শাড়ি কিনেছিলেন। যেগুলি সাধারণত বাঙালি দরিদ্র মহিলারা পরিধান করতেন। এই নীল রং ভার্জিন মেরীর প্রতিনিধিত্ব করত। ফাদার এক্সেম তাকে একটি ছোট যপ মালা এবং ক্রুশ দিয়েছিলেন। ফাদার এর সহায়তায় মাদার তার মায়ের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি তার এই নতুন কর্মকাণ্ডের কথা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। ফাদার তাকে কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আগে প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু ট্রেনিং নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ বস্তি এলাকায় কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছিল না এবং যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই বেহাল ছিল।এর জন্য মাদার বিহারের পাটনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেখানে মেডিকেল মিশন সিস্টারদের সাথে কথা বলেন। বিশপ পেরিয়ার তার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। সিস্টার স্টেফানি মেডিকেল মিশন এর বাকি সিস্টারদের সাথে মাদার কে একটি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ১৬ ই আগস্ট ভ্যাটিকানের এই সিদ্ধান্ত জানার পরে মাদার টেরেজা তার পোশাক পরিবর্তন করেন।দীর্ঘ দুই দশকের অভ্যাস পরিত্যাগ করে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে নীলপাড় সাদা শাড়ি পরিধান করেন। পকেটে ৫ টাকা এবং বিহারের টিকিট নিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে কনভেন্ট পরিত্যাগ করেন।

১৭ ই আগস্ট মাদার গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত পাটনা শহরে পৌঁছান। সিস্টার স্টেফানি তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। দুজন হোলি ফ্যামিলি হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে আগামী কয়েক মাস মাদার প্রাথমিক চিকিৎসার পাঠ নেবেন।হসপিটাল এবং কনভেন্ট বিল্ডিং পাটনার দরিদ্রতম অংশ 'পাদরি কি হাভেলি' নামক অংশে অবস্থিত ছিল। আয়তনে ছোট হলেও হসপিটালটি ছিল আধুনিক। সন্ন্যাসিনী রাই এখানে ডাক্তারি করতেন। বেশিরভাগ স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন ছিলেন। বাকি সন্ন্যাসীরা নার্স,পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাবরেটরীতে কাজ করতেন। কনভেন্টে মাদারের খাওয়ার পাশাপাশি বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল।হসপিটালের সদস্যরা পুরনো চাকরদের কোয়ার্টারে থাকতেন। সেখানে এক হিন্দু রাধুনী ছিলেন এবং রান্নার দিকটা পুরোটা সামলাতেন।হসপিটালটি ছিল খুবই ব্যস্ত এবং মাদার নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অন্ধকারে থাকতেন।তাই নার্সেরা তাকে যথা সম্ভব সাহায্য করতেন চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে।ছাত্র পড়ানোর পরিবর্তে মাদার রোজ এখানে নিত্যনতুন পদ্ধতি শিখতে থাকেন।যখনই কোন গর্ভবতী মায়েদের অপারেশন সংক্রান্ত কেস এসেছে তৎক্ষণাৎ মার্ডার কে সেখানে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে অসুস্থ শিশুদের পাশাপাশি কলেরা রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি শিখছিলেন। তিনি সর্বদা রোগীদের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ভরসা যোগাতেন। কখনো কোন সদ্যো জাত শিশুকে কোলে নিতেন। ক্রমে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন রোগীদের জন্য বিছানা তৈরি, সুচ ফোটানো ওষুধ দেওয়া শিখলেন। একজন পুষ্টিবিদের থেকে স্বাস্থ্যবিধি পর্যাপ্ত বিশ্রামের গুরুত্ব জানতে সচেষ্ট হলেন। ক্রমে তিনি ওই দরিদ্র মানুষগুলির চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের একজন হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন তাদের বিবাহ এবং নানান অনুষ্ঠানে যোগদান করে। পাটনায় থাকাকালীন তিনি তার প্রথম সহযোগী পেলেন যে ছিল এক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত তরুণী। তরুণীটিকে রোগীদের সেবার পাশাপাশি ওষুধ পত্রের বিষয়ে শেখালেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তরুণীটি মাদারের সাথে কলকাতায় সঙ্গী হতে পারেনি কারণ খুব শীঘ্রই হোলি ফ্যামিলি হসপিটালে মারা গেলেন।

চিকিৎসার পাশাপাশি মাদার মেডিকেল সিস্টারদের সাথে তার পরিকল্পনাগুলি নিয়ে আলোচনা করতেন।তাদের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি সমালোচনাগুলো শুনতেন।সিস্টারদের উদ্দেশ্যে তার বার্তা ছিল পরিষ্কার" অসহায় আর্ত-পীড়িত মানুষগুলির সাথে মিশে তাদের সেবা করতে হবে"। দলটি ঠিকমত পরিচালনা করার জন্য তিনি কয়েকটি নিয়ম নীতি প্রবর্তন করলেন। কিছু সিস্টার পরামর্শ দিলেন যে ওই মানুষগুলির সেবার জন্য সিস্টারদের ভালো খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন তাই সকাল নটার আগে কোন প্রার্থনা নয়। মাদার একটি ৮ ঘণ্টার রুটিন অনুসরণের কথা বলেন যা ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হবে।মেডিকেল মিশনারিজ পরামর্শ দেন দিনে এক ঘন্টা সন্ন্যাসিনীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে যার ফলে তারা পুনরায় প্রবল উত্তমের সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারবে। সপ্তাহে একদিন বিশেষ করে রবিবার ছুটির ঘোষণা করা হয়।পোশাকের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের পরনে নীল পাড় সুতি শাড়ি এবং মাথায় আবরণ বাধ্যতামূলক।

পাটনায় কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণের পর মাদার ফাদার এক্সেম কে চিঠি লিখে তার কলকাতা ফেরার ব্যাপারে অনুমতি চান। কিন্তু ফাদার এবং বিশপ দুজনেই চিন্তান্বিত হন। অবশেষে ফাদার পাটনা যাওয়া মনস্থির করেন এবং সেখানে গিয়ে সিস্টার স্টেফানিকে তার আশংকার কথা প্রকাশ করেন যে হঠকারিতায় কোন ভাবে চার্চের পদক্ষেপে মাদারের এই পরিকল্পনা ব্যর্থনা হয়ে যায়। কিন্তু সিস্টার স্টেফানি এবং বাকি সিস্টারেরা তাকে বোঝান যে এই মুহূর্তে মাদারের অবশ্যই কলকাতার দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করা উচিত। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মাদার এখন কলেরা যক্ষা প্রভৃতি রোগ গুলির চিকিৎসা করতে সক্ষম। কলকাতার বস্তিবাসী যারা পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পথ গামী এটাই সুবর্ণ সুযোগ তাদের সেবা করা এবং একটি সুন্দর জীবন দান করা। কোন উপায় না দেখে অবশেষে ফাদার মাদার কে কলকাতায় ফেরার অনুমতি দিতে বাধ্য হন এবং ফলস্বরূপ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর মাদার কলকাতায় ফিরে ২,লোয়ার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে ওঠেন। পাটনা ছাড়ার মুহূর্তে তিনি এক সন্ন্যাসিনী ডাক্তার কে তার আশঙ্কা জানান যে কোথা থেকে তিনি নিজের কাজ শুরু করবেন?কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখেন এবং স্মরণ করেন স্বয়ং ঈশ্বর তার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা।

যদিও কলকাতা ছিল ভারতবর্ষের তৃতীয় সর্বোচ্চ আর্থিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য শহর,তথাপি প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মত এই শহরও ছিল দরিদ্র-বস্তিবাসী এবং রিফিউজিদের। এই শহরের রাস্তাগুলি ছিল ভিক্ষুক এবং কুষ্ঠ রোগীতে ভরা। বহু অযাচিত শিশু, যারা প্রতি মুহূর্তে হয় অনাথ অথবা নানান ক্লিনিক এবং হসপিটালে মৃত্যুবরণ করছে।শহর কলকাতা একদিকে ছিল দুঃখ দুর্দশায় ভরা এক সমুদ্র।

সেন্ট জোসেফের সিস্টাররা দরিদ্রদের ন্যায় জীবনযাপন করত।কেবলমাত্র অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তারা। ফাদারের আনুগত্যে মাদার এই কর্মকাণ্ডে শামিল হলেন। প্রত্যহ তারা সাক্ষাৎ করতেন এবং নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতেন ।১৯৪৮ সালের ২১শে ডিসেম্বর মাদার সেন্ট জোসেফ ত্যাগ করে কলকাতার ভিড়ে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। সকালের খাবারের পর তিনি বাস ধরে সোজা মৌলালি পৌঁছে কাজ শুরু করলেন। দরিদ্র বাঙালি মহিলাদের মত শাড়ি না পড়ে পিঠে কয়েকটি আঁচল করে একটি সেফটি পিন দিয়ে আটকে দেন। পাটনা সিস্টারদের থেকে পাওয়া একটি চামড়ার জুতো পরেন বিনা মোজায়। দুপুরের খাবারের পর তিনি বস্তি এলাকার মতিঝিলে পৌঁছন। পূর্বে সরাসরি কখনো এখানে না এলেও এলাকাটি তার সুপরিচিত ছিল। ফাদার হেনরির নির্দেশে সোডালিটির বহু ছাত্র-ছাত্রী এখানে কাজ করে গেছে।এখানে কোন বড় জলাশয় ছিল না, কেবলমাত্র একটি নোনা পুকুর যা এলাকার বাসিন্দাদের জল সরবরাহ করত। নর্দমার নোংরা জল এবং রাস্তার আবর্জনা এই পুকুরে ফেলা হতো। এখানে না ছিল স্কুল,না হাসপাতাল এবং ডিস্পেন্সারি।ফাদার হেনরি একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন যেখানে ওখানে সেই সব পরিবারের উল্লেখ ছিল যাদের সন্তানেরা কনভেন্টে পড়াশোনা করতো। মাদার বহু পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি স্কুল খোলা আশ্বাস দেন।কিছু সংখ্যক বাবা মা রাজি হন সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে। পরের দিন সকালে তিনি পুনরায় মতিঝিলে যান এবং বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে একটি রেল ব্রিজের নিচে ক্লাস নেয়া শুরু করেন। বোর্ড, পেনসিল ছাড়াই শুরু হয় প্রথম ক্লাস।লাঠি দিয়ে মাটির উপরে বাংলা বর্ণ লিখে তিনি বাচ্চাদের শিক্ষা দান করতে থাকেন।শীঘ্রই মতিঝিলের নিত্য কোলাহলের পাশাপাশি শিশুদের কবিতার ধ্বনি মুখরিত হতে থাকে। সকালের ক্লাসের পর মাদার একটি জায়গা খুঁজতেন দুপুরের খাবারের জন্য। একবার এক কনভেন্টে খাবারের উদ্দেশ্যে গেলে সন্ন্যাসীনীরা ভিক্ষুক ভেবে তাকে তাড়িয়ে দেন। পরবর্তীকালে তিনি কখনো ওই কনভেন্টের নাম প্রকাশ করেননি।

ক্রমে মাদার পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু এটি অবাক করা ব্যাপার ছিল যে একজন একাকী মহিলা ভারতীয় পোশাক পড়ে বস্তির অলিগলি এবং রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি তার শক্তিশালী সমর্থক ফাদার মাইকেল গ্যাব্রিক এবং এক জেসুইট যাজক, যার কর্ম দ্বারা মাদার প্রভাবিত হয়েছিলেন,তার কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয়েছিলেন তারা ভেবেছিলেন তিনি হয়তো পাগল হয়ে গেছেন। বিশপের অনুরোধে মাদার ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৪৮ থেকে ১১ই জুন ১৯৪৯ পর্যন্ত তার প্রাথমিক কাজের একটি রেকর্ড রাখেন। এই মূল্যবান রেকর্ড এর খুব কম অংশ বেঁচে আছে। এই রেকর্ডে তার মতিঝিলের কাজ করার প্রথম দিনগুলির পাশাপাশি সেইসব শিশুগুলি ছিল, যারা ছিল নোংরা। স্বাস্থ্যবিধির পাঠদানের পর তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে শিখেছিল। মুহূর্ত গুলি ছিল হাস্য রসে ভরা। এক দরিদ্র মানুষের পায়ের ফোড়া অপারেশন করে একদিকে রোগী একদিকে মাদার অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। তিনি প্রায়ই বাস ভাড়া দান করে হেঁটে ফিরতেন।

লোরেটোর শান্ত নিশ্চিন্ত জীবন পরিত্যাগ করে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয়েও ভারত বর্ষ এক আভ্যন্তরীণ সংকটের সম্মুখীন হয়। মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং হিন্দুদের জন্য ভারত বর্ষ নামক দুটি রাষ্ট্রের উত্থান হয়। ফলস্বরূপ কলকাতা নগরী প্রত্যহ এক ভয়ঙ্কর অবস্থার সম্মুখীন হতে থাকে। গলিতে রাজপথে মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। খাদ্য সংকটে বহু মানুষ মৃত্যুর দোড় গড়ায়। এই পরিস্থিতিতে মাদার এক দোলাচলে ভুগতে থাকেন নিজের এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে। তিনি কখনোই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। ঈশ্বর স্বয়ং তাকে যে কাজের জন্য নির্বাচিত করেছেন তা তিনি নিষ্ঠাভরে পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই অসহায় পরিস্থিতিতেও বহু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মাসখানেক আগে শুরু হওয়া স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে এখন ৫০। উৎসাহী জনতা বইপত্রের পাশাপাশি টুল, সেট দিয়ে সাহায্য করে। সেন্ট মেরির একজন প্রাক্তন শিক্ষক বিনামূল্যে শিক্ষাদান করতে আসতেন। মাদার স্থানীয় পুরোহিতদের কাছে সাহায্য চান।এক পুরোহিত অনুদান স্বরূপ ১০০ টাকা দান করলে, সেই টাকা দিয়ে মতিঝিলের দুটো বাড়ির ভাড়া মিটানো হয়, যার একটি ব্যবহৃত হতো পঠন-পাঠনের জন্য এবং অপরটি যেখানে দুপুরবেলা শিশুদের দুধ সরবরাহের পাশাপাশি সাবান উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। স্কুলের শিশুদের স্বাস্থ্যবিধির পাশাপাশি ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে আলোচনা করেন। ক্রমে স্কুলটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে।এটি ছিল মাদারের প্রথম বড় সাফল্য।অন্য একটি ঘরে মৃত্যু পথযাত্রীদের চিকিৎসা করা হতো।

কলকাতার রাস্তায় কাজ করার পাশাপাশি মাদারের এক নিজস্ব গৃহের প্রয়োজন হয়। যেখান থেকে তিনি আগামী পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করতে পারবেন।বহু চেষ্টার পর ফাদার এর চেষ্টায় পূর্ব কলকাতায় ক্রিক লেনে বিনা খরচে বাড়ি জোগাড় হয় l স্মৃতি রোমন্থন করে বাড়ির মালিক মাইকেল গোমস বলেছেন -এক সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভেজা অবস্থায় মাদার বাড়ি ফেরেন। বস্তি এলাকায় এক মহিলা দু মাসের ভাড়া না দিতে পারায় মালিকপক্ষ ইচ্ছে করে ঘরের ছাদ ভেঙে দেন । পরের দিন বিকেলে মাদার দু মাসের ভাড়া নিয়ে সেই মহিলাটিকে সাহায্য করেন। পীড়িত মানুষগুলির সেবার্থে তিনি সর্বদা দণ্ডায়মান। কোনো এক সন্ধ্যায় মাইকেল গোমস এবং মাদার অনুদান চাইতে বেরিয়ে বৃষ্টিতে গাছের তলায় এক অসহায় পীড়িত মানুষকে দেখতে পান। দুজনে তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র জোগাড় করে মানুষটির কাছে পৌঁছে দেখেন সে মৃত। এই ঘটনায় তিনি অতি দুঃখ পেয়েছিলেন। দরিদ্র অর্ধাহারে পরিবারগুলির জন্য তিনি গোমস এর থেকে অতিরিক্ত খাবার চেয়ে নিতেন। কোন এক ট্রেনে সফরকালে কয়েক দল মানুষ তার উদ্দেশ্যে কটূক্তি করতে থাকে যে তিনি কেবলমাত্র হিন্দুদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। বহুক্ষণ পরে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন "আমি ভারতের, ভারত আমার"। দলটি বাকি রাস্তা একদম নিশ্চুপ ছিল।

১৯৪৯ সালের ১৯শে মার্চ সুহাসিনী দাস,যিনি ছিলেন মাদারের এক প্রাক্তন ছাত্রী এবং পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন তার এক বিশ্বস্ত সঙ্গী, ক্রিক লেনে আসেন এবং মিশনারিজ অফ চ্যারিটির হয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সিস্টার অ্যাগনেস নাম নিয়ে তিনি চ্যারিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলি পালন করতে থাকেন। কিছু সপ্তাহ পর এক তরুণী ম্যাগডালেনা গোমস যিনি কিনা পরবর্তীকালে সিস্টার জের ট্রুড নামে পরিচিত হন, চ্যারিটি যোগদান করেন। তিনি ছিলেন চ্যারিটির প্রথম ডাক্তার। বছর শেষের দিকে এই তিন নারী অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে পীড়িত মানুষগুলিকে সেবা করতে থাকেন। শীঘ্রই চ্যারিটির সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। গ্রীষ্মের শুরুতে ১০ তরুণী চ্যারিটির কর্মকাণ্ডে শামিল হন। পরে মাত্র দুজন চ্যারিটি ত্যাগ করে চলে যান। বাকি ৮ জন ছিলেন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রথম ব্রতী। প্রত্যেকদিন ব্রতীদের দুটি দলের একটি দল মতিঝিল এবং অপর দল তিল জলার উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন, যেখানে মাদার অন্য একটি পাঠদান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মাদার এবং সিস্টারেরা স্কুলের পাশাপাশি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছিলেন। প্রত্যেকদিন স্কুল শেষের পর সেখানে যক্ষা রোগীদের নিয়ে চিকিৎসা করা হতো। গুরুতর রোগীদের সিটি হসপিটালে পাঠানো হতো। খাদ্য সংকট মেটাতে ফাদার এক্সেম এবং ফাদার হেনরি রবিবার "মুষ্টি ভিক্ষা" নামে একটি বাঙালি নিয়ম চালু করেন, যেখানে অবস্থাপন্ন পরিবার গুলি ভিক্ষুকদের অন্য দিয়ে সাহায্য করত। ক্রমে খাদ্যের পাশাপাশি পোশাক এবং সাবান দান হিসেবে গ্রহণ করা হতো। এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৪৯ এর ১৬ই আগস্ট কনভেন্ট ত্যাগের এক বছর পূর্তি ঘটে। বিশপ ফাদার এক্সেম এর কাছে এই প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেন। দশজনের এই দলটি সাধারণ দল ছিল না, হয়ে উঠেছিল সমস্ত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি অপ্রচলিত গোষ্ঠী।কেবলমাত্র এক জেসুইট মাদার সুপিরিয়র এর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে মাদার টেরেজা শয়তানের হয়ে কাজ করছেন। বিশপ অবিলম্বে সেই পুরোহিতকে টেরেজার সামনে ক্ষমা চাইতে বলেন।

এই সময় ভারত সরকার তাকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং ইউরোপের সাথে তার যেটুকু সংযোগ বেঁচে ছিল তা চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিজের এই নতুন সংগঠনের সিস্টারদের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করেন । ভ্যাটিকানের থেকে পাকাপাকিভাবে সম্মতি আদায় করার জন্য বিশপ তাকে সাহায্য করেন। তিনটি শপথ বাক্য 'দারিদ্রতা,সতীত্ব,আনুগত্য' এবং চতুর্থ শপথ বাক্য 'সমস্ত হৃদয়ের সহিত দরিদ্র থেকে দরিদ্র তমদের সাহায্য করা'-সংযোগ করে একটি খসড়া তৈরি করেন এবং বিশপ তা নিয়ে ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে রওনা দেন। অবশেষে ১৯৫০ সালে ৭ই অক্টোবর জন্ম নেয় "মিশনারীজ অফ চ্যারিটি" ,মাদার টেরেজার স্বপ্নের পথে দ্বিতীয় পদক্ষেপ। ভ্যাটিকান চতুর্থ শপথ বাক্যটির সহিত এই আবেদন মঞ্জুর করেন।

মিশনারিজ অফ চ্যারিটি প্রতিষ্ঠার পর মাদার সতীর্থদের উদ্দেশ্যে এর লক্ষ্য গুলি ঘোষণা করেন যে-" ঈশ্বরের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের এই পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। হৃদয়ের সমস্ত শক্তি এবং ভালোবাসা দিয়ে আমাদের ওই দরিদ্র মানুষগুলির সেবা করতে হবে। ঈশ্বর তার পুত্র যিশুকে আমাদের এই পথের কান্ডারি করেছেন। ঈশ্বরের অংশ হয়েও তিনি মানব সমাজে পদার্পণ করেছেন কেবলমাত্র মানব জাতিকে পাপ হতে বিরক্ত রাখতে, তাই আমাদের যিশুর সেই তৃষ্ণা মেটাতে হবে। তিনি নিজেকে ক্ষুধার্ত,উলঙ্গ, গৃহ হীন, অসুস্থ,নিঃসঙ্গ রূপে উপস্থাপন করেছেন এবং বলেছেন প্রেম ভালোবাসা দিয়ে এই অপূর্ণতা গুলি আমাদের পূরণ করতে হবে এটাই মিশনারী অফ চারিটি প্রধান লক্ষ্য।"

ক্রমে চ্যারিটির সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৫০ এর ৭ই অক্টোবর ফাদার এক্সেম আসেন এবং নতুন সন্ন্যাসিনীদের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। আগামী দু বছরের মধ্যে আরও ২৯ জন সিস্টার হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সন্ন্যাসিনীদের এই ধর্মীয় নীতিগুলি শেষের সময় ফাদার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন যেখানে সবাই বাঙালি কনের সাজে উপস্থিত হন। অনুষ্ঠানের সবার চুলগুলি কেটে তাদের এই আত্মত্যাগের জন্য বাহবা দেন কারণ বাঙালি নারীর কাছে লম্বা চুল অতি গর্বের। গোমস হাউসে জায়গা সংকুলানের জন্য নতুন বাড়ির সন্ধান শুরু হয়। অবশেষে ৫৪ এ, লোয়ার সার্কুলার রোডে এক মুসলিম ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি কেনা হয় এই শর্তে যে, মাদার পরে এই লোন শোধ করে দেবেন। সিস্টারেরা তাদের প্রতিষ্ঠাতার উদ্দেশ্যে বাড়ির নামকরণ করেন" মাদার হাউস"।

চ্যারিটি প্রতিষ্ঠার পর মাদার নতুনদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেন সন্ন্যাসিনী জীবনের সাথে অভ্যস্ত হতে। এ কাজে তাকে ফাদার এক্সেম এবং ফাদার হেনরি সহায়তা করেন।নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বার্তা দেন- দরিদ্র থেকে দরিদ্রতমদের সেবা দিতে হবে এবং দরিদ্রের মতো জীবন যাপন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ভারতবর্ষ ছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়।

১৯৫৩ সালের দিকে চ্যারিটি ঝড়ের গতিতে এগোতে থাকে।এই বছর ১২ই এপ্রিল মাদার চূড়ান্ত শপথ বাক্য গ্রহণ করেন এবং বিশপ পেরিয়ার কে তার প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। ক্রমে চ্যারিটির নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে। বহু সংস্থা অনুদান দিয়ে এর গতি বাড়িয়ে দেয়। নার্স, ডাক্তার ও শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়ে সেবা দান করতে থাকেন। বহু সংখ্যক মানুষ ক্রমে কলকাতার দরিদ্র বস্তিবাসীদের জন্য কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।বস্তির শিশুদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি কলকাতায় মাদার একটি স্কুল স্থাপন করেন। ক্ষুধার্ত,নগ্ন ,গৃহ হীন ,আর্ত ,নিপীড়িত মানুষদের পাশে তিনি স্নেহ নিয়ে কলকাতায় মাত্র ১৩ জন সদস্যের ছোট্ট 'অর্ডার'হিসেবে চারিটি যাত্রা শুরু করেছিল।

১৯৫২ সালে কলকাতা কর্তৃপক্ষের দেওয়া জমিতে মুমূর্ষদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিতক্ত হিন্দু মন্দির কে "কালীঘাট হোম ফর ডায়িং" এ রূপান্তরিত করেন। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র।পরবর্তীতে এই কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন "নির্মল হৃদয়"।১৯৫৫ সালে 'নির্মল শিশু ভবন' স্থাপন করেন, যা ছিল বসতিহীন শিশুদের জন্য আশ্রয়। মরণাপন্ন মানুষের জন্য আঁতুর ভবন, কুষ্ঠ রোগীদের জন্য কুষ্ঠ চিকিৎসালয়। শান্তিনগর এবং তিতলাগরে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সরকারের দেওয়া ৩৪ একর জমিতে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে ওঠে।আগামী ১০ বছরের মধ্যে চ্যারিটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।দিল্লির এক সভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহেরুর সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে তিনি তার কর্মকাণ্ডের কথা বলেন। নেহেরু তাকে অভয় দেন যে তিনি সব জানেন। তিনি ভারতবর্ষের পাশাপাশি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেন এবং চারিটি নিয়ে বক্তৃতা দেন। প্রায় ৩০ বছর পরে রোমে তিনি তার দাদা লাজার এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৬৫ সালে অবশেষে পোপ অনুমতি দেয় চারিটির কাজ কেবলমাত্র ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে।

কলকাতার আর্ত দের সেবার পাশাপাশি বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। একবার খবর পেলেন এক দরিদ্র পরিবার বহুদিন ধরে অনাহারে ভুগছে তিনি তৎক্ষণাৎ কিছু ভাত নিয়ে সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন।বাড়িটিতে পৌঁছানোর পর গৃহকর্ত্রীর উদ্দেশ্যে খাবারটি দান করলে, তিনি তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।কিছুক্ষণ পরে ফিরলে মাদার তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে পাশে এক মুসলিম পরিবার রয়েছে যারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল, তাই অর্ধেক খাবার তিনি তাদের দিয়ে এলেন। আরেকবার যুদ্ধের জন্য কলকাতায় খুব চিনির সংকট দেখা দিয়েছিল। পরিস্থিতি খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই খবর বাচ্চাদের কানে পৌঁছানোর পরে একটি হিন্দু বাড়ির সন্তান তিনদিন চিনি না খেয়ে মাদারদের উদ্দেশ্যে সেটি দান করেছিল।

তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৯ সালের ১৬ই অক্টোবর তিনি "নোবেল শান্তি পুরস্কার"লাভ করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের "ভারতরত্ন" এছাড়াও "পদ্মশ্রী","নেহেরু পুরস্কার", "দেশিকত্তম" লাভ করেন। নোবেল শান্তি পুরস্কারের মঞ্চে বক্তৃতায় তিনি বলেন-"বিশ্বের সবথেকে বড় শান্তি ভঙ্গকারী হল গর্ভপাত। আজ আমরা যারা এখানে উপস্থিত,আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের চেয়ে ছিলেন,অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এই পৃথিবীর বুকে ।কিছু মানুষ রয়েছে যারা আফ্রিকা,ভারত বর্ষে পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন যে এত পরিমান শিশু অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু সেই হতভাগ্য তারা,যারা কেবলমাত্র মায়েদের জন্য পৃথিবীর আলো দেখতে পায় না। আমি ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর বাকি দেশগুলির উদ্দেশ্যে জানাতে চাই ওই শিশুগুলোকে আমাদের দিয়ে দিন। বছরের শুরুতে আমি বলেছিলাম সমস্ত জন্মানো অনাহত অনাগত শিশুদের বছর হোক এটা এবং আজ এটা বছরের শেষ দিন।আমরা কি করতে পেরেছি? আমরা গর্ভপাতের বিরুদ্ধে বহু লড়াই করেছি। বহু ক্লিনিক, হসপিটাল, পুলিশ স্টেশনে জানিয়ে রেখেছি যে তারা প্রাণ গুলো নষ্ট না করে আমাদের দিয়ে দেন। প্রত্যেকদিন প্রত্যেক ঘন্টায় কোনো না কোনো কুমারী মা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং আমরা তাদের আশ্বাস দিই আশ্রয় প্রদানের।"

পরবর্তী কালে তার এই বক্তৃতা নিয়ে বহু বিতর্ক দেখা দেয়। প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনারও শিকার হয়েছেন তিনি বহুবার। কিন্তু প্রতিবার নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। নির্মল হৃদয়ে কাজ করা এক ডাক্তার মার্কাস ফার্নান্দেস মাদার কে বহুভাবে চ্যারিটির হসপিটাল গুলির উন্নতি সাধনের জন্য পরামর্শদান করেছেন। তিনি বলেছেন নির্মল হৃদয়ের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল অপুষ্টি। তাই রোগীদের রুটির পাশাপাশি নানারকম ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। কিন্তু মাদার তার কথায় কর্ণপাত করেননি। মার্কাস লন্ডনে গিয়ে দু'বছর পর তার মেডিকেলের ডিগ্রী সম্পূর্ণ করে যখন নির্মল হৃদয়ে ফিরে আসেন তিনি দেখেন সেখানে তেমন কোন পরিবর্তন নেই,কেবল একটি এক্সের মেশিন যা কিনা পর্যাপ্ত লোকের অভাবে বিকল হয়ে পড়েছিল। জবাব চাইলে মাদার বলেন যে সেখানে কোন যোগ্য ব্যক্তি নেই যে এটা চালাতে পারে। শুনে মার্কাস প্রবল বিস্মিত হন। তার কাছে মাদার ছিলেন ভয়ংকর রকমের এক নির্মম মহিলা। বহু স্বেচ্ছাসেবক যারা নির্মল হৃদয় এ কাজ করেছেন তারা বলেছেন মাদার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দানের পরিবর্তে কেবলমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। একবার এক টিউমার রোগী এসেছিলেন তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দানের পরিবর্তে তিনি ঈশ্বরের ওপরে বিশ্বাস রাখতে বলেন। এছাড়াও বাংলাদেশে মাদার টেরিজা কে নিয়ে একটি সিনেমা তৈরীর কথা ঘোষণা করা হয়। পোপ অনুমতি দিলেও কোন অজ্ঞাতকরণে মাদার এই প্রস্তাব খারিজ করে দেন, ফলে নিউজ পেপার এবং মিডিয়া তাকে আত্মকেন্দ্রিক অ্যাখা দেয়।

ক্রমাগত ভ্রমণের ফলে এবং দেশ-বিদেশের নানান সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ১৯৮৯ সালে মাদারের শরীর ভাঙতে শুরু করে।ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি একটি ভয়ঙ্কর হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হন এবং সার্জারির মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়।সার্জারির মধ্যে দিয়ে শরীরে একটি পেসমেকার বসানো হয়। ১৯৯১ সালে পুনরায় ক্যালিফোর্নিয়া তে হার্ট এবং ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত সমস্যার জন্য হসপিটালে ভর্তি হন। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সর্বদা সক্রিয় ছিলেন নিজের কাজে। কিন্তু ১৯৯৩ সালে রোম সফরকালে পড়ে গিয়ে তার পাঁজরে আঘাত লাগে। জুলাই মাসে তাকে বোম্বে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এক মাসের ভেতরে আবার তাকে দিল্লি চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ক্রমাগত শারীরিক অসুস্থতার জন্য চ্যারিটির প্রধান থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৩ সালে ফাদার এক্সেম মৃত্যুবরণ করেন।এই খবর মাদার কে চরম মানসিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়েছিল । ৫০ বছর ধরে কাজ করা সহজোদ্ধার মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। অবশেষে ১৯৯৭ সালে তিনি অবসর ঘোষণা করেন।জনসাধারণের প্রতি তার শেষ বার্তা ছিল লন্ডনের রানী ডায়নার মৃত্যুত।

৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । মাদার হাউসে প্রাথমিক ক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর তাকে সেন্ট থমাস চার্জে নিয়ে আসা হয়। এক সপ্তাহ পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কলকাতা স্পোর্টস স্টেডিয়ামে যেখানে শ্রদ্ধা জানাতে অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ.জে.সি বোস রোডে মাদার হাউসের গ্রাউন্ডে এক সাধারণ স্ল্যাবের তলায় সৈনিকদের বন্দুকের গুলিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে তাকে শায়িত করা হয়। এখানে তিনি সেই মানুষগুলির সন্নিকটে রইলেন যাদের তিনি সারা জীবন ধরে সেবা করে এসেছেন।।

ঈশ্বরের নামে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আর্তদের সেবা করা সত্ত্বেও তাকে বহুবার বহু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে । কিন্তু প্রতিবারই তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখেছেন। মিশনারিজ অফ চ্যারিটি র কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন "আমরা সবার আগে ধার্মিক; আমরা সমাজকর্মী নই, না শিক্ষক, নার্স বা ডাক্তার। আমরা যিশুর সেবা করি। এই বিবৃতি দিয়ে, মাদার তেরেসা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন আদেশ এবং তার ক্ষমতার সর্বোত্তম অনুসরণ করে তিনি চ্যারিটি কে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন।"