7:56 AM, August 08, 2022
জীবনে যে কোনো বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে গেলে লাগে সৎ সাহস আর সততা। কথায় আছে একটি কলমের ক্ষমতার কাছে তলোয়ারের ক্ষমতাও কিছু না। শিক্ষাজীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন শিক্ষিত মানুষ তার সমস্ত অধিকার সম্বন্ধে ওয়াকিবহল থাকে। কেউ তাকে সহজে ঠকিয়ে নিতে পারেনা। মালালা ইউসুফজাই এর তার জীবনের ওপর লেখা "আই এম মালালা" বইটি বহু মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণার কাজ করে চলেছে। মালালা একজন পাকিস্তানি মেয়ে যে সমাজের কণীতির বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষার জন্য আওয়াজ তোলে এবং তালিবানদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়। এই বইটির অন্য আরেকজন লেখিকা হলেন ক্রিস্টিনা ল্যাম্প। কর্তর পন্থী তালিবানদের আইনের জন্য সেখানের মেয়েরা শিক্ষার আলো দেখতে পারতো না খুব বেশি। তাদেরকে শুধুমাত্র গৃহকর্মে নিযুক্ত রাখা হতো। শুধুমাত্র বাচ্চা জন্ম দেওয়া এবং তাদের দেখভাল করায় যেন একমাত্র জীবনের উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়েছিল। এই সমস্ত কুপ্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে যে মেয়েটি প্রতিবাদ করেছিল সে আর কেউ না সে হলো মালালা ইউসুফজাই। তার লেখা এই বইটিতে তার জীবন কাহিনী সম্বন্ধে আমরা জানব।
আমাদের (মালালা) সমাজে যখন কারো বাড়িতে মেয়ের জন্ম নেয় তখন সবার মুখ ভার হয়ে যায়। সেই মেয়ে বড় হতে না হতে তাকে পর্দার আড়ালে রাখা হয়। কিন্তু ছেলে জন্ম নিলে আলাদাই উৎসবের মরশুম শুরু হয়ে যায়। আমার বাবার ক্ষমতা ছিল না যে আমার জন্মের সময় মাকে হসপিটাল নিয়ে যায়। তাই বাড়িতেই আমার জন্ম। সেই সময় আমার কাকা এসেছিলেন ফ্যামিলি ট্রি নিয়ে নতুন বংশধর এর নাম লিখতে। সেই ফ্যামিলি ট্রিতে কোন মেয়ের নাম লেখা ছিল না কারণ তাদের বংশধরের তালিকায় ধরাই হত না। আমার জন্মের পর বাবা এত খুশি হয়েছিলেন তাই সেই ফ্যামিলি ট্রি নিয়ে তার নামের নিচে তীর চিহ্ন দিয়ে আমার নাম লিখে দেন -'মালালা ইউসুফজাই'। পাকিস্তানি কমিউনিটির অধীনে থাকা আমাদের পরিবারের ফ্যামিলি ট্রি তে প্রথমবার এক মেয়ের নাম যোগ হল। বাবা আমার নাম রেখেছিলেন আফগানিস্তানের বিখ্যাত অভিনেত্রী মালালায়ের নামে। তিনি ছিলেন এক সাহসী মহিলা যিনি অনেক ছোটবেলাতেই তার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ এবং আফগানদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। সেই সময় যুদ্ধে আহত মানুষদের বিভিন্ন মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় যার মধ্যে মালালায় ও ছিলেন। হঠাৎ শিশু মালালাই দেখেন যে তাদের দেশের সৈন্যরা হেরে যাচ্ছে এবং দেশের পতাকা মাটিতে পড়ে লুটাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে পতাকাটি তুলে নেয় এবং একটি টিলার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে সেটি নাড়তে থাকে। এই দৃশ্য আফগান সেনাদের মনে পুনরায় যুদ্ধ করার সাহস যোগায় এবং তারা জিতে যায়। সেই সময় মালালাই গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান।
স্বাত ভ্যালিতে থাকা মালালা জীবন আর বাকি পাঁচটা মেয়ের মতোই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল যারা জীবনে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চাইতো, পড়াশোনা করতে চাইতো। তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার পিছনে ছিল অত্যাচারী এবং হত্যাকারী তালিবানের দল। মালারা ছোট থেকে কখনো একটা স্কুলে পড়াশোনা করেননি। বিভিন্ন কারণে তাকে স্কুল বদলাতে হয়েছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে বুঝতে শুরু করে জীবনে পড়াশোনার ভূমিকা কতখানি। সে তার বাবা-মা এবং ছোট দুই ভাই অটল এবং কুশলের সাথে স্বাত ভ্যালির লিঙ্গরা শহরে থাকতো। এটি ছিল স্বাত ভ্যালির সবথেকে বড় শহর। জীবনের প্রথম পর্যায়ে ভালোই ছিল সবকিছু। তার বাবা মার অবস্থা প্রথমদিকে ভালো না হলেও পরবর্তীকালে তার বাবার স্থাপিত স্কুল থেকে যথেষ্ট রোজকার আসতে থাকে এবং তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠে।
স্কুলে পড়ার সময় সে সব সময় তার ক্লাসের শীর্ষে ছিল। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনিবা ছিল তার প্রিয় বন্ধু। মালাকা ই নুর ছিল মালালার প্রতিদ্বন্দ্বী। ৯/১১ হামলার পর পাকিস্তানের দ্রুত পরিবর্তন হতে শুরু করে। দেশটির আন্তর্জাতিক খ্যাতি অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল কারণ ক্ষমতা এক দল থেকে অন্য দলে বা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যেতে থাকে। তার শৈশব কালে এক শরতের সোয়াত উপত্যকায় একটি বিশাল ভূমিকম্প আঘাত হানে। সুন্দর উপত্যকাটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং দুর্ভোগ কারীরা বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। স্বাত উপত্যকায় তালিবানদের প্রবেশের পর পরিস্থিতি আমূল বদলে যায়। তালিবান একটি ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী ছিল তারা সেই অঞ্চলে তাদের শরিয়া আইনের নৃশংস সংস্করণ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। ফজলুল্লাহ ছিলেন তালিবানদের নেতা। যেহেতু তিনি একজন ক্যারিস ম্যাটিক নেতা ছিলেন অনেক লোক তার প্রবর্তিত কঠোর আইন অনুসরণ করতে শুরু করে। তারা সিনেমা, টেলিভিশন, সিডি, ডিভিডি সহ বিনোদনের আরো অনেক মাধ্যম নিষিদ্ধ করে দেয়। নারীদের পর্দা ছাড়া ঘর থেকে বের হতে দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সোয়াত উপত্যকার মেয়েদের পর্দার আড়ালে থাকার হুকুম দেওয়া হয় এবং তাদের স্কুল কলেজ যাওয়া ও বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় মালালা মাত্র ১০ বছরের ছিল কিন্তু এই ঘটনায় সে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়। তালিবানদের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়ার নিয়ম গুলি সে অমান্য করে। মালালা এবং তার বাবা প্রকাশ্যে ধর্ম এবং শিক্ষার তালিবাণীকরণ হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। সে দৈনিক একটি মেয়ের জীবন তালিবান্ধের নিয়ম-কানুন এ কিভাবে চলে সে নিয়ে ডায়েরি লিখতে শুরু করে। ছদ্মনাম ব্যবহার করার কারণে তালিবানরা তার হদিস পায় না।
অবশেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তালিবানদের সাথে আলোচনা করে এবং তাদের সাথে একটি চুক্তি করে। পাকিস্তান সরকার তাদের শরিয়া আইন প্রবর্তনের অনুমতি দেয় কিন্তু বিনিময়ে তাদের শান্তি প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল, সে শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সেখানে পরিস্থিতি খারাপ হলে লোকজন সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে যেতে শুরু করে। তারা নিষ্ঠুর তালেবানদের থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। মালালার বাবা-মা তালিবানদের থেকে সরাসরি হুমকি না পাওয়া অব্দি সেখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে তারাও একদিন উপত্যকা ছেড়ে চলে যান। তারা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বাস্তবচ্যুত ব্যক্তিদের সাথে যোগ দেয় এবং তারা তিন মাস উপত্যকার বাইরে বসবাস শুরু করে। অবশেষে তারা বাড়ি ফিরে আসেন যখন সরকার ঘোষণা করে যে পাকিস্তানরা উপত্যকা থেকে তালিবানদের বিতাড়িত করেছে। সোয়াতে ফিরে এসে মালালা, শিশু ও নারীদের শিক্ষার প্রয়োজনীয় কথা বলতে শুরু করেন। এই বিষয়ে তার বাবা সব সময় তার পাশে থেকেছেন। এরপর ছিল পাকিস্তানের কেঁপে ওঠার পালা। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেভি শিলরা একটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেন কে হত্যা করে। ওসামা বিন লাদেন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দাগী সন্ত্রাসী। সে কয়েক বছর ধরে সেখানে লুকিয়ে ছিল। জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে তালিবানরা সত্যিই সোয়াত উপত্যকা ছেড়ে যায়নি। মালালার বাবা এরপর ভয় জীবনযাপন শুরু করেন।
একদিন মালালা তার পাশে স্কুল থেকে আসার সময় এক ব্যক্তি বাসে ঢুকে মালালাকে তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। সে তাকে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি করে এবং তাকে গুরুতর আহত করে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে মালালা। পেশোয়ারের আরবি হাসপাতালে মালালার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল কারণ তার মস্তিষ্কে বুলেটটি যেখানে আঘাত করেছিল সেখানে ফুলে যাওয়ার জন্য তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। এটি খুব জটিল অপারেশন হওয়ার সত্বেও সফল হয়। সেই হতভাগ্য মেয়েটির জন্য সারা বিশ্বে মানুষ প্রার্থনা করেছিল। তারা তার বেঁচে থাকার জন্য মসজিদ গির্জা এবং অন্যান্য পবিত্র স্থানে প্রার্থনা করেছিল। তবে ডাক্তাররা নিশ্চিন্ত ছিলেন না। দুই ব্রিটিশ চিকিৎসক রাউয়াল পিন্ডিতে ছুটে যান অবস্থা নির্ণয়ের জন্য। ডাক্তার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন যে তাকে বাঁচাতে হলে তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে হবে। তাকে প্রথমে রাওয়ালপিন্ডীর একটি উচ্চ নিরাপত্তা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু তারপর তাকে একটি বিশেষ বিমানে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে নিয়ে যাওয়া হয়। বহু চিকিৎসার পর সে বেঁচে যায়।
মালালার চলে যাওয়ার দশ দিন পর তার পরিবারও ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায়। মালালা ও তার পরিবার পাকিস্তানের আর ফিরে আসেনি। তারা একটি অ্যাপার্টমেন্টে বস্তি স্থাপন করে এবং তারপর বার্মিংহামের একটি বাড়িতে চলে যায়। কিছুদিনের মধ্যে মালালা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সেনসেশন। মেয়ে এবং শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী শিক্ষার অধিকার জয়ের জন্য তিনি আরও আক্রমণাত্মকভাবে মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন।
4:00 AM, September 01, 2022