4:00 AM, July 31, 2023
CHARLIE CHAPLIN
PETER ACKROYD
"আমি বৃষ্টিতে ভিজে যেতে ভালোবাসি,কারন তখন কেউ আমার অশ্রু দেখতে পাবে না।" বিখ্যাত এই উক্তিটির স্রষ্টা ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, যিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার। নিজের প্রতিভা ও অভিনয় দক্ষতার গুণে হলিউড চলচ্চিত্র কে এক বিরাট উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিখ্যাত লেখক পিটার একরয়েড এর লেখা বই "চার্লি চ্যাপলিন" থেকে আজ আমরা জানবো কিভাবে চরম দারিদ্রতাকে উপেক্ষা করে তিনি এক সাধারন মানুষ থেকে পৃথিবী বিখ্যাত এক অভিনেতায় পরিণত হয়েছিলেন। চ্যাপলিনকে বড়পর্দার শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুক অভিনেতার একজন বলে বিবেচনা করা হয়।
চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন ওরফে চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম হয়েছিল ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের এক অতি দরিদ্র পরিবারে। ছোট থেকেই তিনি খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন, যা পরবর্তীকালে তার কর্মজীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। তার পিতা ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন সিনিয়র এবং মাতা ছিলেন হান্না চ্যাপলিন।তার এক দাদা ছিল, যার নাম ছিল সিডনি। তার পিতা-মাতা উভয়েই থিয়েটারে কাজ করতেন। তার পিতা ছিলেন একজন অভিনেতা ও তার মা ছিলেন একজন গায়িকা। তার পিতা রোজগার যা করতেন বেশিরভাগটাই মদের নেশায় উড়িয়ে দিতেন। ফলে সংসারে নিত্য অশান্তি লেগেই থাকতো। যখন চার্লির মাত্র এক বছর বয়স তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ফলে সংসারে চরম দারিদ্রতা দেখা দেয়। অসহায় মা জীবন ধারণের জন্য গায়িকার কাজটি চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু চার্লির যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন সংসারের দুঃখের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। একদিন গান গাইতে গাইতে মায়ের কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়। ফলস্বরূপ চিরদিনের জন্য তার গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দুঃখের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তাদের মা পাগল হয়ে যান এবং দুই ভাই বাধ্য হয়ে তাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেয়। জীবনধারণের জন্য দুই ভাই অল্প বয়স থেকেই কাজে লেগে পড়ে।
চ্যাপলিন মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই থিয়েটারে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। "শার্লক হোমস" নামের এক নাটকে 'বিলি' নামের এক ছেলের ভূমিকায় প্রথম তিনি অভিনয় করেন। চার্লির অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে এক থিয়েটার মালিক ফ্রেডকারনো তাকে তার এক নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। সেই সময় চার্লির বয়স ১৭। প্রথম দিন অভিনয়ে সবাইকে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। সারা হল করতালিতে ফেটে পড়ে। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি। পরবর্তী দুই বছর এই নাটক দলের জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন। এই সময় হেটি কেটি নামের দলের এক অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েন। কিন্তু হেটির পরিবারের আপত্তিতে প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার স্মৃতি তিনি বহুদিন পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছেন।
১৯০৯ সালের নাটক দলের সাথে তিনি প্যারিসে যান। প্যারিস যাত্রা শেষ করে পুনরায় তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। এই সময় নাটক দলের একটি শাখা আমেরিকায় খোলার ব্যবস্থা হয়েছিল। দলের মালিক ফ্রেডকারনো তাকে আমেরিকায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি তা লুফে নেন। ১৯১০ সালে তিনি আমেরিকা চলে যান। সেখানে তিনি প্রথম অভিনয় করেন 'আউ হাউস' নামের এক নাটকে। এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি রাতারাতি আমেরিকায় জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বহু পত্র পত্রিকা তার অভিনয়ের প্রশংসা করে।
এরপর একে একে তার কাছে অভিনয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। ধীরে ধীরে চার্লির জীবনের অন্ধকার কেটে আলোর রেখা দেখা দিতে শুরু করে। একদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন অ্যাডাম কেসেল নামে এক সিনেমার কর্মকর্তা। নাটক শেষে তিনি চার্লিকে সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। চার্লি যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ততদিনে তার নিজের চিন্তা ভাবনার জগৎ তৈরি হয়েছে। সিনেমা জগতে পরিবর্তন এসেছে। ধীরে ধীরে নির্বাকযুগের সূত্রপাত ঘটেছে।
এতদিনের নাটক জীবনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করলেন। মানুষকে আরো আনন্দ প্রদান করতে স্বকীয়তার পথে হাঁটলেন। এমন কিছু যা একদম আলাদা। সাজ পোশাকের দিকে বিশেষ নজর দিলেন। পাশের ঘরে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে পরিকল্পনা করে চার্লি এক বিখ্যাত সাজের উদ্ভাবন ঘটালেন, যা সারা পৃথিবীতে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ঢোলা ট্রাউজার সাথে ছোট হয়ে যাওয়া জ্যাকেট মাথায় টুপি, গলায় টাই সঙ্গে ছোট্ট ছড়ি এবং সেই বিখ্যাত "খাটো গোঁফ"। এই উদ্ভট রকমের সাজ, যা দেখতে আজগুবি হলেও তাকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
এরপর আর তাকে ঘুরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে তিনি অর্থ, যশ প্রতিপত্তির শীর্ষে পৌঁছতে লাগলেন। তৈরি করলেন 'ইউনাইটেড আর্টিস্ট ফিল্মস'। ১৯১৭ সালে তার অভিনীত ছবি "সোলজার আর্মস" চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা লাভ করল। ধীরে ধীরে তিনি জনসাধারণকে আরও বহু দুর্ধর্ষ ছবি উপহার দিতে থাকলেন। অভিনয় জীবনের পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জীবন ও বর্ণময় হয়ে উঠল। ১৯১৮ সালে তিনি বিবাহ করলেন সুন্দরী তরুণী মিল্ড্রেড হ্যারিসকে। কিন্তু এই বিবাহ সুখের হয়নি। তিনি মোট চার বার বিবাহ করেছিলেন। ছিলেন আট সন্তানের পিতা। সর্বশেষ বিয়ে করেছিলেন উনা ও'নিলকে। এই বিবাহ জীবন ছিল সুখে শান্তিতে ভরা। আত্মজীবনীতে উনার(উনা ও'নিল) আদর্শ কিভাবে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা অকপটে স্বীকার করেছেন।
হলিউড এ কাজ করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন তিনি। নিজস্ব বাড়ি তৈরি হলে মাকে নিয়ে আসেন সেখানে। জীবনের অবশিষ্টকাল তার মা পুত্র দ্বারা সেবায় অতিবাহিত করেছেন।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের এক অন্ধকার অধ্যায়। "দি ডিক্টেটর" ছবির মধ্যে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ আর কৌতুকের মধ্য দিয়ে তিনি হিটলারের চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন। ছবি মুক্তির প্রর প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে কমিউনিজম প্রচারের অভিযোগ ওঠে। চার্লির ছবি ছিল জনসাধারণের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও মানবিক চেতনা ছিল তার ছবির মূল উপাখ্যান।" লাইম লাইট"(১৯৫০), "এ কিং অফ নিউ ইয়র্ক"(১৯৫৭)তার অসামান্য ছবিগুলোর অন্যতম। ১৯১৪ থেকে ১৯৩১ সাল ছিল তার জীবনের বর্ণময় অধ্যায়। জনসাধারণকে অভূত পূর্ণ ছবি উপহার দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন হলিউডের বেতাজ বাদশা। তার অভিনীত কিছু বিখ্যাত সিনেমা হল-
*দি কিড (১৯২১) *দি পিলগ্রিম (১৯২৩) *এ ওম্যান অফ প্যারিস (১৯২৩) *দি গোল্ডরাস(১৯২৫) *দি সার্কাস (১৯২৮) *দি সিটি লাইট (১৯৩১) ইত্যাদি।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি বহু সম্মানে ভূষিত হন। চলচ্চিত্র জগতে অসামান্য অবদানের জন্য ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে তাকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করেন। এছাড়া ১৯২৯ সালে এবং ১৯৭২ সালে "অ্যাকাডেমি হিউম্যান আওয়ার্ড" ১৯৫২ তে "গোল্ড লায়ন" ১৯৫৩ তে "ব্লু রিবন" প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হন। বহু দেশে তিনি রাজসম্মানে সম্মানিত হতে থাকেন।
অবশেষে ১৯৭৭ সালে ৮৮ বছর বয়সে বড়দিনের দিন মানুষকে নির্মল আনন্দদানের এই কারিগর সুইজারল্যান্ডে মৃত্যু বরণ করেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন প্রগতিশীল, সাম্যবাদ ও মানবতাবাদে বিশ্বাসী। নিজ অভিনয় প্রতিভার গুনে তিনি গোটা বিশ্ববাসীর হৃদয়ে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রূপে আজও বিরাজমান।
4:00 AM, September 01, 2022