A THOUSAND SPLENDID SUNS

(তৃতীয় পর্ব)

KHALED HOSSEINI

এতিম খানা থেকে ফিরে আসার পর লায়লা তারেককে তাদের বাড়ির মূল দরজার সামনে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। লায়লার মনে হয় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, তার হাঁটু কাঁপতে থাকে। সে একপাও নড়ার সাহস করেনা, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। লায়লা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তারেককে দেখছিল। একটা কান্নার গমক কেঁপে কেঁপে তার বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। সে এক পা এক পা করে তারপর দৌড়ে ছুটে গিয়ে তারেককে জড়িয়ে ধরে।

লায়লা ও তারেক মুখোমুখি হয়ে দেওয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। উপরের ঘরে জলমাই তার নতুন রাবারের বলটা নিয়ে খেলছিল। মারিয়াম উপরের সিঁড়ি থেকে নিচে বসে থাকা তারেককে দেখছিল, যার একটা আসল পা ও একটা নকল পা। মারিয়াম এখন বুঝতে পারে সেদিন সে ও রাশেদ যখন কন্টিনেন্টাল হোটেলে তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য গিয়েছিল তখন দারোয়ান কেনো তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছিল। সেই দারোয়ানটি ছিল আব্দুল শরীফ, যে মিথ্যে মিথ্যে তারেকের মৃত্যুর খবর নিয়ে এসেছিল। আব্দুল শরিফ তারেকের মারা যাওয়ার যে গল্পটা বলেছিল এই সব ছিল লায়লাকে ছিনিয়ে নেওয়ার একটি অপকৌশল। তারেকের মরে যাওয়ার গল্প ফেঁদে কি পরিমান টাকা রাশেদ ওই ভন্ড আব্দুল শরীফকে দিয়েছিল মারিয়াম তাই ভাবতে থাকে।

তারেককে দেখার পর লায়লা তার গলা শক্ত করে ধরে বেশ কিছুক্ষন কেঁদেছিল। সেই ঘটনার কথা মনে করে লায়লার অসস্তি হয়।‌ সে লক্ষ্য করে তারেকের কয়েকটা দাঁত নেই, তার কথাবার্তায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। তারেক এখন ২৫ বছরের যুবক। তার নরন চরন, কথাবার্তা সব কিছুতেই একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠছে, লম্বা দাড়ি, হালকা - পাতলা কিন্তু দৃঢ় শরীরের গঠন, হাতের পেশীগুলো কর্মঠ মানুষের মত মজবুত।

তারেক বলে কাবুল থেকে চলে যাওয়ার পর পেশওয়ারের নাসিরবাগ শরণার্থী শিবিরে তারা দীর্ঘদিন ছিল। সেখানে তারা কয়েকটা খুঁটি ও কাপড় দিয়ে তাবু বানিয়ে থাকতে শুরু করে। নাসিরবাগের সবকিছুই ছিল বাদামি, বাদামি তাঁবু, বাদামি রঙের লোকজন, বাদামি কুকুর। সেখানে পাতা ছাড়া একটা গাছে উঠে তারেক শরণার্থী শিবিরটাকে দেখতো। বাচ্চারা পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ আগুন জ্বালাচ্ছে, কারো কারো হাতে খেলনার এ কে-৪৭। সেখানে ডায়রিয়া, টিবি, আর ক্ষুধার জ্বালায় অনেক বাচ্চা মারা গিয়েছিল। বিশেষ করে ডায়রিয়ার মারা গিয়েছিল বেশি। তারেকের বাবা প্রথম শীতেই মারা যান। তিনি ঠান্ডা সহ্য করতে পারেননি। ঘুমের মধ্যেই চুপচাপ মারা যান। সেই শীতেই তার মায়ের নিউমোনিয়া হয়। ওই শিবিরেই একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি খুব যত্ন করে তার মায়ের সেবা করেন এবং ঐ শীতে তারেকের মা বেঁচে যান। সেই শীতের পরেই তারা পেশওয়ারে একটি ঘর ভাড়া করে চলে যায়। তারেক বলে শিবিরে প্রায় সময়ই একটা পর একটা ট্রাক আসত। তরুন আর শক্ত পুরুষদের কাজের জন্য নিয়ে যেত। কিন্তু তারেক তার পায়ের কারণে এই ধরনের কাজ পেত না।

তারেক বেশ কিছু সময় কারাগারে ছিল। কারাগারে থাকার বিষয়ে সে লায়লাকে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। শুধু বলেছিল কারাগারে থাকাকালীন সময় সে উর্দু শিখেছিল। তারেক আরো বলে তাকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তার মা কয়েকবার তাকে দেখতে গিয়েছিলেন।

তারেক লায়লাকে জানায় সে তাকে অনেক চিঠি লিখেছিল। সে আরো বলে যে জেলখানায় একজন বয়স্ক লোকের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। লোকটি ছিল পাকিস্তানের প্রাক্তন হকি প্লেয়ার। সে বেশ কয়েকবার কারাগারে ঢুকেছে আবার বের হয়েছে। সেই লোকটিই তারেকের মার বিষয়ে খোঁজখবর এনে দিত এবং সে-ই তারেককে তার মার মৃত্যুর খবরটা এনে দিয়েছিল। তারেক পাকিস্তানের কারাগারে সাত বছর কাটিয়েছিল।

তারেক বলে সে খুব ভাগ্যবান ছিল তাই সে খুব দ্রুত মুক্তি পেয়েছিল। তার বিচার শেষ হওয়ার পর ২০০০ সালের শীতের শেষের দিকে সেলিম তারেককে তার ভাইয়ের ফোন নম্বর দিয়েছিল। সেলিমের ভাইয়ের নাম ছিল সাঈদ। সাঈদের মুররিতে একটি হোটেল রয়েছে, বিশাল রুম আর বড় একটা লাউঞ্জ। পর্যটকদের জন্য বেশ আদর্শ একটি জায়গা। সাঈদের কাছে যাওয়ার পর সে তারেককে খুব আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করে। সে সেখানে থাকতে থাকতে হোটেলের সব কাজ শিখে ফেলে। সাঈদ তারেককে একজন দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ করে। মাস শেষ হওয়ার আগেই সাঈদ তারেককে তার পাওনা বুঝিয়ে দিত।

সাঈদ তারেকের প্রতি সদয় হয়ে তাকে হোটেলের পেছনে একটি খুপরিতে থাকতে দেয়, তার দুপুরের খাবার ফ্রী করে দেয়, তাকে নতুন একটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেয় এবং তাকে একটি নতুন উলের কোট কিনে দেয়।

লায়লাও তারেককে সবকিছু খুলে বলে। সে বলে কিভাবে একটি লোক তাকে তারেকের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল এবং সে লোকটিকে বিশ্বাসও করেছিল আর কোন পরিস্থিতিতে সে রাশেদকে বিয়ে করেছিল। লায়লা তারেককে আজিজার কথা বলে। বিয়ে করার জন্য তারেক লায়লাকে দোষ দেয় না। তারেক বলে যে সে আজিজার সাথে দেখা করতে চায় আর লায়লা নিশ্চিত করে যে সে এর ব্যবস্থা করবে।

তারেক আজিজার নাম কয়েকবার উচ্চারণ করে।

লায়লা লক্ষ্য করে রাশেদ যখন এই নামটা উচ্চারণ করে তখন শুনতে কেমন হাস্যকর আর বিচ্ছিরি লাগে। অথচ তারেক যখন উচ্চারণ করল তখন কেমন মধুর শোনালো। দশ বছর পর তারেকের সাথে লায়লার দেখা হয়। লায়লা অতীতের সব কিছু মনে করতে শুরু করে। রাশেদের অত্যাচারের কাহিনী শুনে তারেকের চেহারাটা হঠাৎ করে কেমন বিবর্ণ হয়ে ওঠে। লায়লা তারেকের এই চেহারা চেনে। অনেক আগেই সে একবার তার নিজের কৃত্রিম পা টা খুলে খাদেম নামের একটি ছেলেকে তার দলবলসহ পিটিয়েছিল লায়লাকে উত্ত্যক্ত করার কারণে। তারেক একহাতে লায়লাকে ও অন্য হাতে তার নিচের ঠোঁট টা স্পর্শ করে। তারেকের স্পর্শের সাথে সাথে লায়লার সেদিনের কথা মনে পড়ে যেদিন সে আজিজাকে গর্ভে ধারণ করেছিল। তারেক খুব আলতোভাবে ফিসফিস করে লায়লাকে বলে সে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। শুধুমাত্র লায়লাকে দেখার জন্য সে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। সে জানায় সুযোগ পেলেই সে লায়লাকে বিয়ে করবে। লায়লা তার চোখটা নামিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে এবং সে তারেককে জানায় দুপুর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত রাশেদ বাড়িতে থাকে না। সে তারেককে দুপুরের পর আসতে বলে। তখন সে তাকে আজিজার কাছে নিয়ে যাবে।

সেদিন তারেক চলে যাওয়ার পর রাতে খাবার শেষে জলমাই রাশেদকে জানায় তাদের বাড়িতে একজন পুরুষ এসেছিল এবং সে মামির (লায়লার)‌ বন্ধু। জলমাই আরো বলে যে সে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। রাশেদ নিশ্চিত হতে রাগত স্বরে লায়লাকে প্রশ্ন করে সে যাকে ভেবেছে সেই এসেছিল কিনা। রাশেদ জলমাইকে প্রশ্ন করে সে তখন কোথায় ছিল । উত্তরে জলমাই জানায় সে তখন মারিয়ামের সাথে উপরের তলায় খেলছিল, এবং লায়লার কথা জিজ্ঞেস করলে জলমাই জানায় সে নিচের তলায় সেই লোকটির সাথে কথা বলছিল। মারিয়াম দেখে রাশেদের চেহারাটা বেশ শান্ত হয়ে গেল। তার কুঁঞ্চিত ভ্রুটাও স্বাভাবিক হয়ে আসল। ঠিক জাহাজের নাবিকের মতো। বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নাবিক যেমন শান্ত হয়ে যায় রাশেদকে সেরকম মনে হচ্ছিল। জলমাইয়ের দিকে তাকিয়ে রাশেদ তাকে উপর যেতে বলে। জলমাইয়ের চেহারায় মারিয়াম আতঙ্কজনক কিছু ফুটে উঠতে দেখে। সে কয়েক পলক মারিয়ামের দিকে আর তার মায়ের দিকে তাকায়। রাশেদ জলমাইয়ের কনুই ধরে তাকে উপরে নিয়ে যায়। মারিয়াম ও লায়লা বরফের মতো শক্ত হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা একে অপরের চোখের দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছিলনা। তারা শুনতে পায় উপরের তলায় খুব ভারী হাঁটার শব্দ। থপথপ করে সিঁড়ি ভেঙে রাশেদ নিচে নেমে আসে। মারিয়াম দেখল রাশেদ তার আঙ্গুলের গাঁটে চামড়ার বেল্টটা পেচাতে পেচাতে আসছে। মারিয়াম তাকে থামাতে যায় কিন্তু রাশেদ এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দাও। কোনো কথা না বলে রাশেদ লায়লার ওপর বেল্টটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে আচমকা এতজোড়ে বেল্ট দিয়ে লায়লাকে মারে যে লায়লা ফেরানোর কোনো সময়ই পায় না। লায়লা তার কপালে হাত দিয়ে রক্ত দেখতে পায় । রাশেদ বেল্টটা আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। এবার লায়লা তার হাত সামনে দিয়ে বেল্টের আঘাত আটকানোর চেষ্টা করে। সে বেল্টটা জোর করে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। রাশেদ আবার মারার জন্য বেল্ট উঁচু করে। এই সুযোগে লায়লা বেল্টটা ধরে নেয়। মারিয়াম চিৎকার করে রাশেদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থেকে। রাশেদ এবার মারিয়মকে আঘাত করতে চাইলে লায়লা একটু ফাঁকা পেয়ে রাশেদের কানের নিচে ঘুসি মারে। মুহূর্তেই রাশেদ লায়লাকে ধরে দেওয়ালের সাথে আছড়ে পরে। তারপর বেল্ট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। বেল্টের স্টিলের অংশটা লায়লার যেখানেই আঘাত করছিল সেখান থেকেই রক্ত ঝরে পড়তে শুরু করে।

অবশেষে রাশেদ লায়লাকে মারা শেষে মারিয়মের দিকে ঘুরে তাকায়। চোখ দুটো সরু করে সে মারিয়ামের দিকে একবার দেখে। তার সেই চোখে ছিল নিষ্ঠুরতা আর নীরবতা। রাশেদের এই রকম চোখ দুটোই মারিয়ম অনেক কাল আগে তার বিয়ের সময় সর্বপ্রথম আয়নার ভেতর তার বাবার সাথে দেখেছিল। মারিয়াম নিজেকে জিজ্ঞাসা করে এই লোকটার সাথে সে কি এমন খারাপ আচরণ করেছে যে এই লোকটা তার সাথে এমন নির্মম আচরণ করে, তাকে এভাবে অত্যাচার করে, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে।

রাশেদ তার বেল্টটা একবার ঝাড়া দিয়ে নেয়, তারপর মারিয়মের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে মারিয়াম দেখে যে লায়লা উঠে দাঁড়িয়েছে। সে হাতে করে কিছু একটা নিয়ে রাশেদের দিকে এগোচ্ছে। লায়লার হাতে পানিসহ কাঁচের পাত্র ছিল। সে তা দিয়ে সজোরে রাশেদের মুখের ওপর আঘাত করে। রাশেদের গলা চেহারা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে তার শার্টের উপর পড়ছিল। সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তারপর লায়লার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। লায়লাকে নিয়ে মেঝের উপর পড়ে যায় এবং হাত দিয়ে লায়লার গলা চেপে ধরে। মারিয়াম রাশেদকে আঁচড়িয়ে তার বুকে থাপ্পড় দিয়ে, তার মাথার চুল টেনে ধরে লায়লার গলা থেকে রাশেদের আঙুল ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু করতে পারে না। রাশেদ লায়লাকে দম বন্ধ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। মারিয়াম কোনো উপায় না দেখে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে উপরের তলায় ছোট ছোট পা দিয়ে কেউ একজন চাপাচাপি করছে নিচে আসার জন্য। কিন্তু উপরের তলার ঘরটা তালা মারা। মারিয়াম দৌড়ে যন্ত্রপাতির ঘরের ভেতর থেকে শাবলটা হাতে নেয়।

মারিয়াম যখন ঘরে ফিরে আসে রাশেদ তা লক্ষ্য করে না। সে তখনও লায়লার ওপর গলা চেপে বসে আছে। মারিয়াম লক্ষ্য করে লায়লা আর প্রতিরোধ করতে পারছে না। লায়লা প্রায় নিথর হয়ে যাচ্ছে। মারিয়াম ভাবে এই লোকটা তার জীবনের ২৭ টা বছর কেড়ে নিয়েছে, সে লায়লার জীবনটাও কেড়ে নিতে দেবে না। মারিয়াম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে তার হাতদুটো দিয়ে আরো দৃঢ় ভাবে শাবলটা ধরে, তারপর চিৎকার করে রাশেদকে ডাকে। রাশেদ ঘুরে তাকানো মাত্রই সে তীব্রভাবে শাবল দিয়ে আঘাত করে। সে রাশেদের মুখ বরাবর আঘাত করে। রাশেদ তার মাথায় হাত দিয়ে চোখের সামনে হাত দুটো নিয়ে এসে দেখে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে অবিশ্বাসী চোখে মারিয়ামের দিকে তাকায়। তার সেই চোখে আরো কিছু ছিল হয়তো, হয়তো সমবেদনা কিংবা একধরনের ক্ষমা প্রার্থনা। রাশেদ উঠে দাঁড়ায়। মারিয়াম ভাবে এই মুহূর্তে যদি সে তাকে যেতে দেয় তাহলে সে কয়েক মুহূর্তে উপরের ঘরের তালা খুলে বন্দুকটা নিয়ে আসবে এবং একই সাথে মারিয়াম ও লায়লাকে হত্যা করবে। মারিয়াম শাবলের ধারালো অংশটা ঘুরিয়ে ধরে এবং তার শরীর সমস্ত শক্তি দিয়ে সে আঘাত করে।

লায়লার মুখের ওপর যে চেহারাটা ছিল সেই মুখটা সে তখনও সচেতন ভাবে দেখছিল,তামাক খাওয়া দাঁত আর হিংস্র চোখ। তার আশপাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছিল, হাত-পা অসার হয়ে আসছিল। সবকিছু যখন অন্ধকার হয়ে আসছিল তখন এর মধ্যে তার ওপর চেপে বসা রাশেদের মুখটা বেশ সূর্যের আলোর মত তার মুখের ওপর জ্বলজ্বল করছিল। তার চোখের সামনে তার বাচ্চা দুটোর চেহারা ভেসে ওঠে, আজিজা ও জলমাই। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন অন্ধকারটা আবার ফিকে হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তার চেতনা ফিরে আসে। মাথার ওপর ঘরের ছাদটা সে আবার দেখা শুরু করে। লায়লা শ্বাস নিতে চেষ্টা করে, গলায় ব্যথা পাচ্ছিল।

জ্ঞান ফিরে আসার পর উঠে বসে প্রথমে সে রাশেদকে দেখতে পায়। রাশেদ তার পিছনে ভর দিয়ে পড়ে আছে, চোখ দুটি খোলা। তারপরও মনে হচ্ছিল যেন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মুখটাও খোলা ছিল। মুখ দিয়ে সাদা গেজলা বেরিয়ে তার শার্ট ভরে গেছে, রক্তে সারা শরীর ভিজে গেছে। লায়লা রাশেদের পাশেই শাবলটা দেখতে পায়। লায়লার মুখ দিয়ে ভয়ংকর একটা চিৎকার বের হয়ে আসে।

লায়লা গুনগুন করে কাঁদছিল। মারিয়াম মৃত রাশেদের পাশে শান্ত হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সে চেষ্টা করছিল রাশেদের খোলা চোখের দিকে তাকে যেন না তাকাতে হয়। একদম নিথর হয়ে‌ সে রাশেদের পাশে বসেছিল। বেশ কিছু সময় পর সে বেশ শান্ত সুরেই লায়লাকে ডাকে। লায়লা অনুগত ভাবে বসে এবং বলে মৃত রাশেদকে সরাতে হবে। জলমাই এসবের কিছুই দেখেনি।

রাশেদকে বিছানার চাদর দিয়ে জড়ানোর আগে মারিয়াম রাশেদের পকেট থেকে ঘরের চাবিটা বের করে নেয়। তারপর তাকে চাদর দিয়ে ভালো করে পেচায়। লায়লা রাশেদের পা ধরে আর মারিয়াম ধরে হাত। তারা রাশেদকে উঠিয়ে নিয়ে বের করার চেষ্টা করতে লাগে। কিন্তু রাশেদ বেশ ভারী ছিল। ফলে তাকে টেনে নাড়ানো মারিয়াম ও লায়লার জন্য বেশ কষ্টকরই ছিল। বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পর কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই তারা রাশেদকে উঠোনে নিয়ে আসে। তারা রাশেদের উঠোনের কর্নারে যন্ত্রপাতি রাখার যে ছোট্ট ঘরটা আছে সেখানে নিয়ে যায়। ঘরটার মধ্যে হাতুড়ি, শাবল, করাত সহ আরো অনেক কিছু ছিল।

তারা আবার ঘরে ফিরে আসে। মারিয়াম তার হাত ধুয়ে চুলগুলো গুছিয়ে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে লায়লাকে লক্ষ্য করে তার ক্ষত গুলো আগে পরিষ্কার করে দেওয়ার কথা বলে এবং এও বলে যে রাতে সে খুব ভালো ভাবে চিন্তা করতে পারবে পুরো ব্যাপারটা কিভাবে শেষ করা যায়। লায়লা ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে বলে তাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে, সে লায়লা আজিজা জলমাই আর তারেক। এই অভিশপ্ত শহর ছেড়ে তাদেরকে এমন জায়গায় চলে যেতে হবে যেখানে তাদেরকে কেউ খুঁজে পাবে না। শান্ত ও নিরাপদ একটা জায়গায় তাদেরকে আশ্রয় নিতে হবে। লায়লা স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত মারিয়াম খুব শান্ত ভাবে বসে ছিল। তারপর লায়লার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বলে ভয়ের কোনো কারণ নেই, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। লায়লার মানসিক অবস্থা এখন তালগোল পাকানো। সে কিছুই উপায় বের করতে পারবে না।

লায়লা জলমাইয়ের ছোট্ট কাঁধটা চেপে ধরে গলায় চুমু খায়। জলমাই তার বাবাজানের কথা জিজ্ঞেস করলে লায়লা জানায় সে বাইরে গেছে। এই প্রথমবার সে জলমাইকে এত বড় একটা মিথ্যে কথা বলে। তাকে এই মিথ্যেটা আরো অনেক বার বলতে হবে। লায়লার চোখের সামনে ভেসে ওঠে যখন রাশেদ বাড়িতে ফিরে আসে তখন জলমাই ছুটে যায় তার বাবার কাছে। বাবা আর ছেলের মধ্যে তখন ভীষণ রকমের হুটোপুটি হয়। ছেলের জন্য লায়লার মনে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। লায়লা যখন ঘুমাতে যায় তখন তার বুকটা নানারকম চিন্তায় ভার হয়ে ওঠে। কিন্তু আযানের শব্দে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেশ ফুরফুরে লাগে নিজেকে।

মারিয়াম সারারাত তার ঘরে হাঁটাহাঁটি করেছে আর পরিকল্পনা করেছে কিছু একটা পথ বের করার জন্য। লায়লা শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে মারিয়ামের ঘরে ঢোকে। মারিয়াম তখন প্রার্থনার মতো করে জানালার পাশে বসেছিল। লায়লা আস্তে আসতে মারিয়ামের পাশে গিয়ে বসে। মারিয়ম আজকে সকালেই লায়লাকে আজিজার সাথে দেখা করতে বলে। লায়লা গড়গড় করে উঠে মারিয়ামকে বলে সে তাকে ছাড়া কোথাও যাবে না। সে লায়লা তারেক আর বাচ্চারা একসাথে থাকবে। পাকিস্তানে তারেকের একটা জায়গা আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেখানে তারা লুকিয়ে থাকতে পারবে। মারিয়াম শান্ত ভাবেই তাকে জানায় সেটা সম্ভব না। তালেবানরা রুটি চুরির অপরাধে হাত কেটে নেয়। যখন তারা জানবে একজন স্বামী মারা গেছে আর তার দুই স্ত্রী গায়েব তখন তারা ঠিক তাদের খুঁজে নেবে এবং তারা মারিয়ামের পাশাপশি লায়লাকেও দোষী সাব্যস্ত করবে। তখন তাদের বাচ্চাদের কী হবে, কে তাদের লালন পালন করবে। মারিয়ম লায়লার কোঁকড়ানো চুল গুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় এবং বলে তার জন্য সবকিছুর শেষ এখানেই। তার জীবনের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই। লায়লার সন্তানরা তাকে অনেক সুখ দিয়েছে।

সেই সকলেই মারিয়াম জলমাই ও আজিজার জন্য দুপুরের খাবার বানিয়ে লায়লাকে দেয়। মারিয়াম জলমাইয়ের দিকে তাকায়। তার গায়ে ছিল লাল রঙের একটা শার্ট, পায়ে কাউবয় জুতো। এটা তার বাবা মান্দাই বাজার থেকে কিনে এনেছিল। জলমাই দুহাত দিয়ে তার নতুন বলটা ধরে আছে। মারিয়াম তার গালে চুমু খায় এবং তার কাছে ক্ষমা চায়।

লায়লা জলমাইয়ের হাত ধরে রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তার বাঁকের কাছে লায়লা আবার পেছন ফিরে তাকায়,‌ দেখে মারিয়ম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়াম খুব আন্তরিক ভাবে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। তারা রাস্তার বাঁকটা পার হয়ে আসে। এরপর লায়লা আর কখনও মারিয়মকে দেখতে পাইনি।

চিকেন স্ট্রিটে শারই নাও অট্টালিকায় মেয়েদের জন্য কারাগার বানানো হয়েছিল। এই কারাগারেই মারিয়াম ছিল। মারিয়াম আর অন্যান্য মহিলাদেরকে যেই ঘরটায় রাখা হয়েছিল সেই ঘরটা একটা দরজা দিয়ে পৃথক করা হয়েছিল। তারা যেই ঘরটায় ছিল তার ছিল নোংরা ও অমসৃণ। ছোট ছোট জানালা দিয়ে কারাগারের উঠোন দেখা যেতো।‌ জানালো গুলো খোলা ছিল, কোনো পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকতো না। দরজাটায় কোনো লক না থাকায় তারা উঠোনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারত। জানালায় পর্দা না থাকার কারণে কোনো কোনো মহিলাবন্দি অভিযোগ করত যে পাহারায় থাকা তালেবানরা তাদের দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত কিংবা সিগারেট খেয়ে জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ত। ফলে মেয়ে বন্দিরা সারাদিন বোরখা পড়ে থাকত। সন্ধ্যেবেলায় তারা বোরকা খুলত যখন কারাগারের মূল দরজাটা বন্ধ হত আর প্রহরীরা চলে যেত।

মারিয়াম যে ঘরটায় থাকতো সেখানে তার সাথে আরো পাঁচজন মহিলা আর চারজনে শিশু‌ থাকতো। রাতের বেলা তাদের ঘরটা অন্ধকার থাকায় যেসব রাতে বিদ্যুৎ থাকত তখন কারাগারের মহিলারা নাগমা নামের একটা বাচ্চা মেয়েকে বিদ্যুতের তার দিয়ে সিলিংয়ের উপরে উঠিয়ে দিত। নাগমা তখন সেই তার দিয়ে ঘরের ভেতর বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করত। পায়খানাটা ঘরের সাথেই ছিল। একটা চারকোণা মেঝেতে ছোটো একটা ফুটো করে বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পায়খানার মাছিগুলো সারাক্ষণই ভনভন করে সেখানে উড়ে বেড়াতো।

কারাগারের ঠিক মাঝখানে একটি চারকোনা উঠোন ছিল। উঠোনের মাঝে একটা কুপ ছিল। কূপের আশেপাশে পানি সরে যাবার কোনো নালা ছিল না। ফলে কাপড় ধোঁয়ার,‌ স্নান করার নোংরা পানি গুলো সারাক্ষণই সেখানে জমা থাকত। উঠোনে বাচ্চারা খেলাধুলা করত।

মারিয়াম শুনেছে এই কারাগারের ভেতরে অনেক বাচ্চার জন্ম হয়েছে যারা বাইরের পৃথিবীকে দেখার সুযোগই পায়নি। মারিয়ামকে যে কারাগারে রাখা হয়েছিল সেখানে তার সাথে আর যে সমস্ত মহিলাবন্দি ছিল তাদের তেমন কোনো গুরুতর বা ভয়াবহ কোনো অপরাধ ছিল না। তাদের প্রত্যেককেই হয়ত রাস্তায় একা একা বের হয়েছে কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে বন্দি করা হয়েছে। একমাত্র মারিয়ামের অভিযোগটাই খুব গুরুতর ছিল। ফলে কারাগারে তাকে সবাই বেশ সমীহ করত। সে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল কারাগারে। সবাই তাকে ঘুমানোর জন্য কম্বল দিত, তার সাথে খাবার ভাগাভাগি করত। নাগমা সব সময় মারিয়ামের সাথে তার কনুই ধরে আঠার মত লেগে থাকত। নাগমা জানায় তার বাবা তাকে তার চেয়েও ৩০ বছরের বড় একটা কাপড়ের মিস্ত্রির সাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে আরো বলে স্থানীয় এক মোল্লার ছেলেকে সে পছন্দ করত। তারা বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর তাদেকে ধরে আনা হয় এবং ছেলেটাকে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তখন ছেলেটা স্বীকার করে যে নাগমা তার সৌন্দর্য দিয়ে ছেলেটাকে প্ররোচিত করেছে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য। ছেলেটা আরো প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে এরকম কাজ আর করবে না। ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর নাগমাকে পাঁচ বছরের জন্য কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নাগমার কথা শুনতে শুনতে মারিয়ামের তার মায়ের কথা মনে পড়ে যিনি তাকে বলেছিলেন যে কম্পাসের সুঁই যেভাবে দিক নির্ণয় করে সেভাবে পুরুষের আঙুল সব সময় মেয়ে মানুষদের দোষ খুঁজে বের করে।

এক সপ্তাহ পর মারিয়ামের বিচার শুরু হয়। কোনো লিগ্যাল কাউন্সিল ছিল না, কোনো সাক্ষী ছিল না, তার পক্ষে কথা বলার মত কেউ ছিল না, এমনকি তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতোও কেউ ছিলনা। মাত্র ১৫ মিনিটেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়। বিচারক তাকে তার দোষ স্বীকার করার কথা জিজ্ঞেস করলে মারিয়াম জানায় যে সে তার দোষ স্বীকার করে।

কারাগারে এরপর মারিয়াম দশ দিন ছিল। কারাগারের জানালা দিয়ে সারাদিন সে অন্যান্য কয়েদিদের জীবন দেখত। কারাগারে যেদিন মারিয়ামের সর্বশেষ দিন সেদিন নাগমা তাকে একটা উপহার দেয় এবং মারিয়মের হাত ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। মারিয়াম জানালার পাশে বসেই দিনের বাকি অংশটা কাটায়। দেখে অন্যান্য কয়েদিরা উঠোনে হাঁটছে, কেউ রান্না করছে, বাচ্চারা খেলা করছে, তারা দলবদ্ধ ভাবে একটা ছড়া বলছিল। মারিয়ামের মনে পড়ে অনেককাল আগে তার বাবা জলিল যখন তাকে দেখতে আসত তখন সে আর তার বাবা এরকম একটা ছড়া একসাথে বলত।

গাজী স্টেডিয়ামে মারিয়ামকে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজার হাজার চোখ তাকে দেখছিল। তাকে নিয়ে ট্রাকটা যখন স্টেডিয়ামে ঢোকে তখন চারিদিকে তীব্র হৈচৈ চিৎকারে ভরে ওঠে। একটা মাইকে যখন মারিয়ামের অপরাধটা উচ্চস্বরে বলা হয় তখন স্টেডিয়ামের মানুষজন নড়েচড়ে ওঠে। সকালে মারিয়াম ভয় পাচ্ছিল সে হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে কিংবা পড়ে যাবে। কিন্তু ট্রাক থেকে নেমে সে একাই হেঁটে যেতে থাকে, কারো সাহায্য লাগে না।

জীবনে অনেক সুন্দর কিছু থাকলেও মারিয়াম জানত জীবন তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। জীবন তার প্রতি মোটেও দয়ালু ছিল না। সে যখন শেষ বিশ কদম হেটে‌ যাচ্ছিল তখন মারিয়াম আশা করছিল সে হয়তো শেষবারের জন্য লায়লাকে একটিবার দেখবে, তার প্রাণ খোলা হাসি শুনবে, কিংবা আজিজাকে দেখবে। মারিয়ামের বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল এই ভেবে যে সে আর আজিজাকে দেখতে পাবে না। গোলপোস্টের একদম কাছে আসার পর তার পাশে যে লোকটা ছিল সে তাকে থামতে বলে। মারিয়াম ছায়ার মধ্যে দেখতে পায় লোকটার হাতে একটা রাশিয়ান কালাশনিকভ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মারিয়াম তার অতীতের কথা মনে করতে থাকে। অবৈধভাবে তার জীবনটা শুরু হলেও তার শেষ হচ্ছে বৈধ মৃত্যুর মাধ্যমে।

চতুর্থ খণ্ড:-

তারেকের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। মাঝে মাঝে লায়লা দেখে তারেক ঘুম থেকে উঠে বিছানার এক কোনায় মাথা চেপে ধরে বসে আছে। তারেক বলেছে সে যখন নাসিরবাগের কারাগারে ছিল তখন থেকেই তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। কখনো কখনো লায়লা একটা কাপড় ভিজিয়ে তারেকের কপালে ধরে। এতে কিছুটা উপশম হয়। আবার মাঝে মাঝে সাঈদের ডাক্তার তাকে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটা তাকে কিছুটা শান্ত করে। কিন্তু কোনো কোনো রাতে সারারাতই তারেক‌ তার মাথা চেপে ধরে জেগে থাকে। চোখ তখন রক্তিম হয়ে থাকে।

যেদিন তারা মুররিতে এসে পৌঁছায় সেদিনই তারা বিয়ে করে। সাঈদ তার কয়েকজন বন্ধুকে আর একজন মোল্লা ডেকে সেদিনই বিয়ের কাজটা শেষ করে ফেলেছিল। সাঈদ তাদেরকে কিছু টাকাও দিয়েছিল। সে রাতে তারা স্বামী স্ত্রীর মতো পাশাপাশি ঘুমায়। লায়লা ভেবেছিল অনেক কথা বলবে। কিন্তু প্রথম রাতে সে কোনো কথাই বলতে পারেনা। তারেকের পাশে সে আছে এটাই তাকে আনন্দ দিচ্ছিল, এটাই ছিল তার জন্য আশীর্বাদ।

লায়লা মুররির ঠান্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, অন্ধকার রাতের তারা, ঝিকঝিকে আকাশ এ সব কিছুই অনেক ভালোবাসে। তার কাছে সবচেয়ে শান্তির বিষয় ছিল তাদের একটি পরিপূর্ণ বাথরুম রয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তারেক এবং বাচ্চাদেরকে একসাথে ঘুমাতে দেখে কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ভিজে ওঠে। বিয়ের কয়েক দিন পরেই লায়লা আজিজাকে তারেকের বিষয়ে সব কিছু খুলে বলে। তারেক ও আজিজার ভেতর যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল সেটা আসলেই খুব অদ্ভুত ছিল। তাদের এরই মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছিল।

তারেক জলমাইয়ের জন্য অনেকগুলো খেলনা নিয়ে আসে কিন্তু জলমাই সেগুলোর একটাও নেয় না, সবগুলোই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রাতের বেলা লায়লা জলমাইকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে জলমাইয়ের বাবা যে প্রার্থনা করে তাকে ঘুম পাড়াত সেই প্রার্থনা করেই ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করত। ঘুমানোর সময় জলমাই তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে লায়লা জানায় সে চলে গেছে এবং কবে ফিরে আসবে তা কেউ জানে না। লায়লা‌ এই মিথ্যে কথাটা নিয়ে খুব লজ্জিত ছিল।

মুররিতে লায়লা বেশ সুখে ছিল। তার এই সুখ খুব সহজে আসেনি, অনেক বেদনা ও মূল্যের বিনিময়ে এসেছে। ছুটির দিনে তারেক বাচ্চাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। কখনো কখনো ফিরে আসার সময় তারা যখন কোনো দোকানের কাঁচের গ্লাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় তখন সেই গ্লাসের প্রতিফলনে দেখতে পায় একজন পুরুষ, একজন স্ত্রী, তার মেয়ে আর সন্তান। একটা সুখী পরিবার হেঁটে যাচ্ছে।

লায়লা প্রায় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন দেখে তারা আবার কাবুলে ফিরে গেছে। সে কাবুলের বাড়িটার বারান্দা দিয়ে হাঁটছে।

একদিন রাতে তারেক লায়লাকে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব জানায়। কিন্তু লায়লা কোনভাবেই আর সেখানে ফিরে যেতে চায় না।

মুররির জীবনটা লায়লার কাছে বেশ শান্তিপূর্ণ আর ঝঞ্ঝাট মুক্ত ছিল। এখানকার কাজ তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। ছুটির দিনগুলোতে তারা বাচ্চাদেরকে নিয়ে ঘুরতে যেত। এমন একটা জীবনের স্বপ্নই লায়লা সব সময় দেখে এসেছে।

এক রাতে তারেক ও লায়লা তাদের দেশের মধ্যে কি কি পরিবর্তন হচ্ছে সেটা নিয়ে আলোচনা করছিল। অনেক কিছু ঘটে গেছে আফগানিস্তানে। প্রতিটি বড় শহর থেকে তালেবানরা পালিয়েছে। দেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরেই লায়লার ভীষণভাবে কাবুলের কথা মনে পড়ছে। তার শৈশবের কাবুল। কাবুলে নাকি এখন রাস্তাঘাট ঠিক করা হচ্ছে, নতুন নতুন স্কুল হচ্ছে, মেয়েরা আবার তাদের কাজে ফিরে যাচ্ছে। লায়লা তার বাবা মায়ের কথা মনে করতে থাকে। সবচেয়ে বেশি যার জন্য সে কাবুলে ফিরে যেতে চাইছিল সে হল মারিয়াম। লায়লা নিজেকে জিজ্ঞেস করে সে কি এখনো বেঁচে আছে নাকি নিজেকে উৎসর্গ করেছে। লায়লা তারেককে জানায় সে ফিরে যেতে চায়। তারেক অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে সে এখানে অসুখী কিনা। উত্তরে লায়লা জানায় সে এখানে ভীষণ সুখী কিন্তু তারা যেহেতু কাবুল থেকে এখানে এসেছে এবং এখন কাবুলে অনেক ভালো ভালো বিষয় হচ্ছে, তাই সে তার অংশ হতে চায়। কাবুলের জন্য কিছু একটা করতে চায়। তারেক রাজি হয় এবং লায়লা জানায় সে প্রথমে হিরাত শহরে যেতে চায়। লায়লা আজিজাকে ব্যাখ্যা করে যে তারা কাবুলে ফিরে যাচ্ছে সেখানে আর এখন তালেবানরা নেই। আর সেখানে কোনো যুদ্ধও নেই। আজিজাকে আর এতিমখানায় পাঠানো হবে না। তারা একসাথে থাকবে। মুররি ছেড়ে যাওয়ার সময় জলমাঈ কিছুতেই আলীওনা নামের ছাগলটাকে ছেড়ে যেতে চায়নি। তারেক তাকে আশ্বস্ত করে যে কাবুলে গিয়ে তারা আবার এমন একটা ছাগল কিনবে। তখন জলমাই শান্ত হয়। তারা বিদায় নেওয়ার সময় সাঈদের চোখে পানি এসে গেল। সে একটা কোরআন ধরে রাখে। লায়লা আর তারেক তিনবার করে কোরআন শরীফে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বের হয়।

আফগানিস্তানের যুদ্ধ কাবুল, হিরাত আর কান্দাহারের সাথে সংযোগ রাস্তাগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। হিরাতে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হল ইরানের মাসাদ শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া। লায়লা আর তার পরিবার একটা রাত সেখানে থাকে। তারা একটি হোটেলে রাত কাটায়। পরের দিন সকালে তারা আবার অন্য বাসে করে রওনা দেয়।

মাসাদ খুব জনাকীর্ণ শহর। তারা যখন বাসে করে যাচ্ছিল তখন বাসের জানালা দিয়ে লায়লা অসংখ্য মানুষ, মসজিদ,পার্ক, কাবাব ঘর দেখতে পায়। গাড়িতে করে ইরান, আফগান সীমান্তে পৌঁছাতে ১০ ঘন্টা লেগে যায়। খুব সহজেই তারা হিরাত সীমান্তে চলে আসে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় তারা একটি শরণার্থী শিবির দেখে। হিরাতের অধিকাংশ রাস্তাঘাটই শান বাঁধানো। কয়েকটা মিউনিসিপালের পার্ক দেখা যায়। নতুন নতুন অট্টালিকা হচ্ছে, ট্রাফিক লাইটগুলো কাজ করছে। তারা একটি হোটেল ভাড়া করে এবং ক্লান্ত থাকার দরুণ সেদিন রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে তারেক লায়লার জন্য একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে আসে। এটি চলা শুরু করলে জলমাই কান্নায় ভেঙে পড়ে। একটু পরেই সে তারেকের হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। লায়লার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তারেক আর জলমাইয়ের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

গুল দামান গ্রামটায় মাটি আর খড়ের তৈরি কুঁড়ে ঘরের পাশে কয়েকটা অট্টালিকার দেখা গেলো। ট্যাক্সিটি একটি একতলা বাড়ির সামনে এসে থামে। বাড়ির দেয়ালের ওপর দিয়ে ডুমুর গাছের শাখা-প্রশাখা দেখা যাচ্ছে। লায়লা ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে যায়।

লায়লা মোল্লা ফয়জুল্লাহর বাড়ি যায়। একজন মধ্যবয়সী লোক দরজা খোলে। সে ছিল মোল্লা ফয়জুল্লাহর ছেলে হামজা। হামজা লায়লাকে জিজ্ঞেস করে সে কোনোভাবে তাকে সাহায্য করতে পারবে কিনা। লায়লা তাকে জানায় যে সে মোল্লা ফয়জুল্লাহর একজন পুরাতন বন্ধু মারিয়ামের পক্ষ থেকে এসেছে। মারিয়ামের নাম শুনে হামজাঊর চোখ দুটি স্থির হয়ে যায়। সে চোখ পিটপিট করে জিজ্ঞেস করে “ মারিয়াম!... জলিল খানের মেয়ে? .. সে এখনো বেঁচে আছে? সেকি এখানে এসেছে?” লায়লা বলে তার ধারণা মারিয়াম মারা গেছে। কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে হামজা লায়লাকে ভেতরে আসার জন্য অনুরোধ করে।

তারা খুব সুন্দর গোছানো একটি ঘরের মেঝেতে বসে। ঘরের দেওয়ালে কাবা শরীফের ছবি ছিল। একটা ছেলে এসে সবুজ চা আর কিছু খাবার দিয়ে যায়। পাশের ঘর থেকে মেয়ে লোকের ফিসফিস শব্দ শোনা যাচ্ছে। লায়লা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু খুলে বলে। কথা যখন শেষ হয় তখনও হামজা কিছু বলেনা শুধু স্থির হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর হামজা বলে তার বাবা মারিয়ামকে খুব পছন্দ করতেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি তাকে দেখতে যেতেন। তিনি মারিয়ামের শিক্ষক ছিলেন, বন্ধু ছিলেন। জলিল খান যখন তাকে নিয়ে যায় তখন তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।

লায়লা হামজাকে অনুরোধ করে মারিয়াম যেখানে থাকত সেই বাসাটা তাকে দেখানোর জন্য।

ড্রাইভার আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে রাজি হয়। হামজা ও লায়লা বের হয়ে আসে। তারা ১৫ মিনিট হাঁটার পর একটা ঘাসে পূর্ণ সংকীর্ণ রাস্তা পার করে। একটা এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পার হওয়ার পর তারা একটি পাহাড়ি রাস্তা ধরে। প্রচুর ঘাস তাদের পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। মশার গুনগুন চারিদিকে‌ শোনা যাচ্ছিল। হামজা জানায় এখানে একটা ঝর্ণা ছিল কিন্তু এখন সেটা শুকিয়ে গেছে। হামজা বলে সে এখানে অপেক্ষা করছে এবং লায়লাকে কুঁড়েঘরের রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়। লায়লা পাথরের রাস্তার বড় বড় পাথর পার হয়ে সামনে এগোতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেই উইলো গাছের সারি দেখতে পায় যেমনটা মারিয়ম তাকে বলেছিল। লায়লা এবার ছুটতে শুরু করে। তার পায়ে পাথরের আঘাত লাগছিল কিন্তু সে সেটাকে পাত্তা দেয়না।

অবশেষে সেখানে সে পৌঁছায়। পৌঁছে দেখে কুঁড়েঘরের জানালাটা একেবারে খালি, দরজাটা কেউ নিয়ে গেছে। মারিয়াম তাকে একটা কাঠের ঘরের কথা বলেছিল তার চিহ্ন নেই । মাছি ভনভন করে চারপাশে উড়ছে। লায়লা ঘরের ভেতর ঢোকে। কয়েক মুহূর্ত লাগল তার সবকিছু চোখে সয়ে আসতে। সবকিছু সয়ে আসার পর সে দেখে ঘরটাকে সে যত বড় ভেবেছিল আসলে তত বড় নয়। ঘরের মেঝেতে শ্যাওলা জমে গেছে। মেঝে এবড়ো খেবড়ো, এখানে সেখানে ময়লা পড়ে আছে। লায়লা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। জানালার পাশের উইলো গাছটার ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। লায়লা সেটা শুনতে পায়। ঘরের চালে মাকড়শা বাসা বেধেছে। লায়লা কিছুক্ষণের জন্য তার চোখ দুটি বন্ধ করে। পাকিস্তানে যখন ছিল তখন সে কিছুতেই মারিয়ামের চেহারাটা মনে করতে পারছিল না। কিন্তু এখন খুব সহজেই মারিয়ামের মুখটা তার সামনে ভেসে উঠে। যেন সে আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে।

ঘর থেকে বের হওয়ার আগে লায়লা আর একবার ঘরটার দিকে তাকায় যেখানে তরুণী মারিয়াম ঘুমাত, স্বপ্ন দেখত, বাবার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলত। “বিদায় মারিয়াম” লায়লা নিজের অজান্তেই কাঁদতে শুরু করে। ঘাসের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আসার পর সে দেখে হামজা তখনো একটা পাথরে বসে আছে। তাকে দেখে হামজা উঠে দাঁড়ায় এবং ফিরে যাওয়ার কথা বলে আর লায়লাকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।

লায়লা বাড়ির সামনের বাগানে অপেক্ষা করছিল। সকালে যে ছেলেটা তাদেরকে যা দিয়েছিল সে একটা মুরগি হাতে নিয়ে ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। হামজা একটা বাক্স সাথে করে নিয়ে এসে লায়লাকে দেয় এবং বলে জলিল খান মারা যাওয়ার দুই মাস আগে এটা তিনি মোল্লা ফয়জুল্লাহকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যদি মারিয়াম এসে দাবি করে তাহলে যেন সে তাকে এটা দেয়। মোল্লা ফয়জুল্লাহর কাছে এটা দু'বছর ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পর এটা হামজাকে দিয়ে গেছেন যেন তিনি তা মারিয়ামকে দেয়। কিন্তু মারিয়াম আর ফিরে আসেনি। হামজা একটা চাবিও লায়লাকে দেয় এবং বলে তার বাবা কখনো এটা খুলে দেখেননি, হয়তো খোদার ইচ্ছে যে লায়লাই এটা খুলে দেখবে।

লায়লা যখন হোটেলে ফিরে আসে তখনও তারেক বাচ্চাদেরকে নিয়ে ফিরে আসেনি। লায়লা বিছানায় বসে চাবি দিয়ে বাক্সটা খোলে। ভেতরে সে একটা চিঠি আর একটাভিডিও ক্যাসেট পায়। তারা যখন হোটেলে রুম ভাড়া করেছিল তখন রিসেপশন থেকে তাদের বলেছিল দোতলায় শুধু একটা ভিসিআর রয়েছে। লায়লা ভিডিও ক্যাসেটটা নিয়ে ছুটে যায় সেখানে। হল রুম তখন ফাঁকা ছিল, ভিসিআরও ফাঁকা ছিল। কর্মচারী ভিডিও ক্যাসেটটা ছেড়ে দেয়। পর্দা কিছুক্ষণ অন্ধকার থাকার পর মিউজিক শুরু হয়, তারপর ছবি দেখানো শুরু হয়। লায়লা এর মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। টিভি স্ক্রিনে চলছিল ওয়ার্ল্ড ডিসনির পিনাকীও মুভিটা। জলিল খান কেন তার মেয়েকে মুভিটা দিল এর কোনো কিছুই লায়লা বুঝতে পারেনি।

তারেখ বাচ্চাদের নিয়ে যখন হোটেলে ফিরে আসে তখন ছয়টা বাজে। আজিজা লায়লার কাছে ছুটে এসে তাকে দেখায় যে তারেক তাকে কানের দুল কিনে দিয়েছে এবং জলমাই দেখায় তাকে একটা ডলফিন কিনে দিয়েছে। তারেক লায়লার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে সে কেমন আছে। উত্তরে লায়লা জানায় সে ঠিক আছে এবং পরে সে তাকে সবকিছু বলবে। সকালে হোটেলে ফিরে এসেই লায়লা ভিডিও ক্যাসেটটা দেখা শেষ করে কাগজের খামটা খুলেছিল। ভেতরে দাগটানা কাগজে নীল কালি দিয়ে লেখা একটি চিঠি, যা ছিল একজন বাবার তার মেয়ের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা এবং তাকে তার প্রাপ্ত সুখ দিতে না পারার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা।

সেই রাতে হোটেলে ফিরে আসার পর বাচ্চারা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন লায়লা তারেককে চিঠির বিষয়ে সব কিছু খুলে বলে। সে তারিককে বাক্সের ভেতরে যে টাকা ছিল সেগুলোও দেয়। লায়লা যখন কাঁদতে শুরু করে তখন তারেক তাকে কাছে টেনে তারা কপালে চুমু খায় এবং হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।

অবশেষে খরা আর শুষ্কতা শেষ হয়। বেশ কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হয়। কাবুল নদী উপচে পরে পানিতে। বসন্তকালীন বন্যায় টাইটানিক সিটি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। জলমাইয়ের বয়স এখন ছয় আর আজিজার দশ। গত সপ্তাহে আজিজার জন্মদিন উদযাপন করেছে। তাকে নিয়ে পার্কে গিয়েছে, টাইটানিক ছবি দেখেছে। সিনেমা দেখা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত।

লায়লা কাবুলে ফিরে বেশ অবাক হয়েছিল। শহরটা পুরো পাল্টে গেছে। লোকজন তাদের পুরানো বাড়িঘর আবার রং করেছে। তালেবানদের ছোড়া রকেটসেল গুলো যেগুলো ফাঁকা ছিল লোকজন সেটার মধ্যে ফুল ভরে সাজিয়ে রেখেছে। তারা বলে এটা হল রকেট ফুল।

সকাল আটটা বাজে। লায়লা ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে। আজিজাও তার সাথে উঠে সকালের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ করে লায়লা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমায়। তারেক অফিস যাওয়ার সময় তার কপালে চুমু খেয়ে যায়। সে একটা এনজিওতে কাজ পেয়েছে।

লায়লা তার বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়। ঠান্ডা সকালে তারা রাস্তায় বের হয়। রাস্তায় খুব ভিড়। ঘুম ঘুম চোখে দোকানদাররা তাদের দোকান খুলছে।

এতিমখানার পরিচালক জামান খোলা বাগানে হাঁটু ভাঁজ করে বাস্কেটবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে একদল ছেলেকে কোনো নির্দেশনা দিচ্ছিল। লায়লাকে দেখে জামান তার বলটা হাতের নিচে নেয় তারপর ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে কিছু নির্দেশ দেয়। ছেলেরা সবাই একসাথে চিৎকার করে ওঠে “সালাম মুয়াল্লিম সাহেবা।”

লায়লা সালামের উত্তর দিয়ে এতিমখানার ভেতরে ঢুকে যায়। তারেক‌ আর জামান মিলে পুরো এতিমখানাটা নতুন করে সাজিয়েছে। অনাথ বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য লায়লা নতুন বিছানা কিনে এনেছে। কাবুলের সংবাদপত্রে এতিমখানার এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। যেখানে জামান, তারেক আর লায়লার ছবি ছাপা হয়েছে।

বাচ্চারা ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছিল। লায়লাকে দেখে তারা ছুটে আসে। সকাল সকাল লায়লার কাজ হল বাচ্চাদের শান্ত করে ক্লাসে বসানো। ক্লাসরুমটাকে তারেক আর জামান সুন্দর করে সাজিয়েছে। তারেক একটা সাদা বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে। সেখানে কবিতার লাইন লেখা আছে।

তারা যখন প্রথম কাবুলে ফিরে আসে তখন লায়লা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে তালেবানরা কোথায় মারিয়ামকে কবর দিয়েছে। সে আশা করেছিল মারিয়ামের কবর জিয়ারত করবে, সেখানে ফুল দেবে। কিন্তু এর পরেই তার মনে হয়েছে মারিয়াম তাদের কাছ থেকে দূরে নেই। কবর খুজে না পেলেও কোনো সমস্যা নেই। মারিয়াম তাদের সাথেই আছে। এই দেওয়ালের চারপাশে যেটাকে পুনরায় সাজানো হয়েছে কিংবা যে গাছগুলো লাগানো হয়েছে তার সাথে অথবা এতিম বাচ্চারা যে গরম কম্বল শরীরে দেয় তার উষ্ণতার সাথে মারিয়াম জড়িয়ে আছে।

গল্পটি শেষ হয় লায়লার পুনরায় মা হওয়ার খবরের সাথে। প্রতি রাতে লায়লা বাচ্চাদের সাথে নাম নিয়ে খেলা করে। সবাই নিজেদের পছন্দ মতো নাম বলে। লায়লা শুধু পুরুষ নাম নিয়েই খেলে। কেউ মেয়েদের নাম বলে না। কারণ মেয়ের একটাই নাম লায়লা পছন্দ করে রেখেছে।

তিন দশক পার হওয়ার পরেও আফগানিস্তানের শরণার্থী সমস্যা একটি প্রকট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্ববাসীর জন্য। যুদ্ধ, ক্ষুধা, নৈরাজ্য আক্রমণ গল্পের তারেক আর তার পরিবারের মতো লক্ষ্য আফগানকে বাধ্য করেছে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে কিংবা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তান অথবা ইরানে আশ্রয় নিতে। ২০ লাখেরও বেশি আফগান পাকিস্তান শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকার ইউ এন এইচ সি আর-এর হয়ে লেখক আফগান শরণার্থী শিবিরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। ইউ এন এইচ সি আর-এর মূল লক্ষ্য হল শরণার্থীদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে চলা, তাদেরকে জরুরী সময়ে সাহায্য করা, নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা।

সমাপ্ত